দেশে সক্রিয় সমন্বিত দুর্নীতিবাজ চক্র

মোহাম্মদ আবু নোমান: আমরা দৃশ্যত মাকড়সার জালে জড়িয়ে গেছি। যত বের হতে চাচ্ছি, ততই আটকে যাচ্ছি। দেশটা যেন দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। কিছু লোকের স্বার্থের জন্য বাংলাদেশের মতো পরিশ্রমী, দক্ষ ও মেধাবী জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া যায় না। এই কুখ্যাত কালো হাতগুলো থেকে দেশটাকে রক্ষা করতে হবে। সুশাসন, সুবিচার ও জবাবদিহির অভাবে চোরগুলো ডাকাতে পরিণত হয়েছে। শুরুতেই এসব সরকারি বা জনপ্রতিনিধি চেতনাধারী চোরদের ধরে যদি কঠিন শাস্তির আওতায় আনা যেত, তাহলে ডাকাতের জন্ম হতো না।

চার হাজার ২৮০ কোটি টাকার প্রকল্পে অস্বাভাবিক দাম

একটি চেয়ারের দাম ছয় লাখ টাকা। দুধে কী পরিমাণ পানি আছে, তা মাপার একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩২ হাজার টাকা। একটি বর্জ্য রাখার পাত্রের দাম আড়াই লাখ টাকা। স্কুলে স্কুলে দুগ্ধজাত পণ্য প্রদর্শনীর পেছনে ব্যয় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চার হাজার ২৮০ কোটি টাকার প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডি) প্রকল্পের কেনাকাটায় এই অস্বাভাবিক দাম অনুমোদন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে গরু-ছাগল উন্নয়নে বিদেশ সফরের ব্যবস্থাও আছে। বাংলাদেশের আধুনিক ও বিলাসী আসবাবপত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অটবি ও আকতার ফার্নিচারের শোরুমের কর্মরতরা বিস্ময়ভরে সংবাদমাধ্যমে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে ছয় লাখ টাকা দামের চেয়ার তৈরিই হয় না। অটবিতে কর্মরতরা জানান, তাদের শোরুমে এখন সর্বোচ্চ দামের চেয়ার আছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে। আর একটি অফিস টেবিলের সর্বোচ্চ দাম ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। তারা বলেন, ছয় লাখ টাকার চেয়ারের কথা শোনেননি কখনও। কোনো বিবেকবান মানুষের মধ্যেই দুঃখ, লজ্জা, বেদনা ও ক্ষোভ সঞ্চারিত না হয়ে পারে না এসব উচ্চশিক্ষিত ও অসৎ ব্যক্তির দুর্নীতির কর্মকাণ্ড দেখে। প্রধানমন্ত্রী একাই কতটুকু কী করবেন! যে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত দায়িত্বশীল ব্যক্তিই অসৎ। ঘুষ দিয়ে অযোগ্য লোক চাকরি নেওয়ার পর কতটা দ্রুত ঘুষের টাকা উত্তোলন করা যায়, সব চোরেরা মিলে সে প্রতিযোগিতা শুরু করে।

পণ্যমূল্যের ব্যাপক তারতম্য

যে কোনো সচেতন নাগরিক রাজধানীর আসবাবপত্রের বিভিন্ন বিলাসী শোরুম ও আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটগুলোয় খোঁজ নিলে প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয়ের সঙ্গে বাস্তবের আকাশ-পাতাল অমিল খুঁজে পাবেন। বাজারমূল্যের সঙ্গে প্রকল্পের পণ্যমূল্যের ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়। যেমন দুধে পানি মাপার যন্ত্রের দাম তিন লাখ ৩২ হাজার টাকা ধরা হলেও বাজারে এই যন্ত্র পাওয়া যায় ৬০ টাকায়। গাভি গর্ভবতী কি না, তা পরীক্ষার জন্য ৬৫ ইউনিট কিট কেনা হবে। এ জন্য বরাদ্দ ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রতি ইউনিট (এক হাজারটি) কিটের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অথচ বাংলাদেশে গাভি গর্ভবতী কি না, তা হাত দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। কিটের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। প্রান্তিক খামারির মধ্য থেকে গর্ভবতী অবস্থায় চার হাজার গরুর ১০০ দিনের খাবারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রতি কেজি খাবার কেনা হবে ৮০ টাকায়। বাজারে গরুর জন্য সবচেয়ে দামি খাবারের প্রতি কেজির দাম সর্বোচ্চ ৩৬ টাকা। মাঠকর্মীরা সাইকেলে বহন করতে পারবেন এমন কিটবক্স কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দুই কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রতিটি কিটবক্সের ব্যয় ধরা হয়েছে সাত হাজার টাকা। বাজারে এ ধরনের কিটবক্সের দাম ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার ২৫০ টাকা। এছাড়া কেনাকাটার তালিকায় আছে দুধে পানি পরীক্ষার যন্ত্র। এ ধরনের যন্ত্র (মিল্ক টেস্টার) কেনা হবে প্রতিটি তিন লাখ ৩২ হাজার টাকায়। এ খাতে ৩০০ সেট যন্ত্র কিনতে ব্যয় হবে ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অথচ সায়েন্টিফিক মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৬০ টাকার যন্ত্রটি দিয়েই দুধে পানি আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। আর দুধের ফ্যাটসহ বিভিন্ন মান পরীক্ষায় যেসব যন্ত্র ব্যবহার যায়, তা আট হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

এই হচ্ছে শিক্ষিত ও মেধাবী প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের অবস্থা। সৎ ও নীতিমান কর্মকর্তা বা রাজনীতিবিদদের জন্য অবমাননাকর হলেও বলতে হয়, এই যদি হয় মেধার প্রয়োগ, তাহলে আমরা রক্ষা চাই এসব মেধাবী শকুনের হাত থেকে। অন্যায়ভাবে টাকাখেকো শুধু কতিপয় মনুষ্যপ্রাণীর উন্নয়নের দ্বারাই কী জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব?

আমরা কি তাহলে ভুল পড়ালেখা করেছি

একটি দেশের উচ্চশিক্ষিত প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা, তথা সরকারি চাকরিজীবীরা যদি এভাবে দুর্নীতি করে, তাহলে সেই দেশের সাধারণ নাগরিকদের কী করার আছে? গরু-ছাগল উন্নয়ন ও কেনাকাটা নিয়ে যখন ওরা দুর্নীতি করছে, তখন সাধারণ জনগণকে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম’ ছাড়া কী করার আছে? এখন বলতে হয়, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড নয়, বরং ‘দুর্নীতির কারিগর’। আমরা কি তাহলে ভুল পড়ালেখা করেছিÑযে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত! কিন্তু আমাদের দেশে যে যত বড় শিক্ষিত, সে তত বড় দুর্নীতিবাজ! শিক্ষিত ব্যক্তিরা নীতি-নৈতিকতার বই পড়েও দুর্নীতি করে দেশটাকে শেষ করে দিল।

দুর্নীতির মহোৎসবের খণ্ডচিত্র এলডিডি

আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় দুর্নীতির বিষবৃক্ষ। এর সাম্প্রতিক ফল পাপিয়া, সংসদ সদস্য শহিদ, ক্যাসিনো সম্রাট, শামীম, সাহেদ ও সাবরিনারা। বালিশ-পর্দা কাণ্ড আমাদের দেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। স্বল্পমাত্রায় কিছু দুর্নীতি উম্মোচিত হলেও অধিকাংশ দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ এখনও আমাদের অজানা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেনাকাটায় প্রকাশিত দুর্নীতির এ মাত্রা দেশব্যাপী চলমান দুর্নীতির মহোৎসবের খণ্ডচিত্র মাত্র। তাদের হাতে ডেইরি সেক্টরের দায়িত্ব আছে বলেই এই সেক্টরে উন্নতি হয়নি। দুধে-ভাতে বাঙালি বলা হলেও দেশে দুধের এত দাম। এখন দুধ-ভাত বা গরুর মাংস গরিব কেন মধ্যবিত্তদের জন্যও যেখানে কল্পনা, সেখানে তারা গাড়ি আর ফার্নিচার বিলাসে মত্ত। গরু-ছাগলের উন্নয়নে বিদেশ সফর না করিয়ে মানুষের মতো দেখতে ওইসব প্রাণীর মানুষ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। অসাধু কিছু মানুষের কারণে জাতি লজ্জিত? তারা দল ও প্রশাসনের জন্য অভিশাপ।

বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থাও আছে

এলডিডি প্রকল্পের অধীনে বিদেশযাত্রার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গরু-ছাগল পালনের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে এ প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের এক হাজার ৫০ জনকে বিদেশে পাঠানো হবে। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি ছয় লাখ ৬৫ হাজার টাকা। জনপ্রতি ব্যয় হবে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও বিদেশে গরু-ছাগলের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ৭৫ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পেছনে ব্যয় হবে চার কোটি ৯৮ লাখ টাকা। জনপ্রতি ব্যয় ছয় লাখ ৬৪ হাজার টাকা। গরু-ছাগলের উন্নয়নের নামে তাদের প্রশিক্ষণ না দিয়ে, প্রথমত প্রকৃত মানুষ হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। বালিশকাণ্ড থেকে আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে এখন গরুকাণ্ডে ঠেকেছি। বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সরকারি সব সেক্টরসহ কতিপয় চেতনাধারী ‘অচেতন’ হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে অতীতের মতো আবার চ্যাম্পিয়ন হতে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ফল পেতে খুব বেশি দেরি করতে হবে না হয়তো!

প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রেজাউল করিম

অস্বাভাবিক এই ব্যয়ের বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি আসার আগেই এই কেনাকাটার দর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। কোনো প্রকল্পে অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য নয়। এর আগে আমি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম, সেখানে রূপপুর বালিশ-কাণ্ডের ঘটনায় ৩২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তারা জেলে গেছেন। এফআর টাওয়ারে অভিযুক্ত ৬২ জনের নামের তালিকা আমরা প্রকাশ করেছি। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটার অনুমোদিত দাম প্রস্তাবে অসংগতি থাকলে অভিযুক্তদের শাস্তি পেতে হবে। কোনোভাবেই অস্বাভাবিক কেনাকাটা প্রশ্রয় দেবে না এই মন্ত্রণালয়।’ প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বলছেন, অসংগতি থাকলে অভিযুক্তদের শাস্তি পেতে হবে। অসংগতি আছে কি না, সেটা কী তিনি জানেন না? বাইরের কেউ এসে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে? গণমাধ্যমে প্রকাশের আগে দায়িত্বশীলরা খুব কমই জানতে পারেন।

সক্রিয় সামগ্রিক দুর্নীতির চক্র

যে কোনো প্রকল্প শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ পেরোনোর পর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন, প্রজেক্টের প্রাথমিক অনুমোদন, পরিকল্পনা কমিশন, এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়, ক্যাবিনেট ডিভিশন, একনেক প্রভৃতি। অথচ অস্বাভাবিক দাম কারও চোখে পড়েনি। এর অর্থ হলো দেশে একটি সামগ্রিক দুর্নীতির চক্র সমম্বিতভাবে সক্রিয়। দুর্নীতিবাজরা তাদের কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কতিপয় সংবাদমাধ্যমকে হাত করে রাখে। ফলে তাদের অপকর্ম প্রকাশ পায় না। চুনোপুঁটি দু-একজন ধরা পড়লেও তাদের শাস্তি হয় না। তারা আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায়। আর রুই-কাতলারা অধরাই থেকে যায়! প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আসার আগেই এই কেনাকাটার দর প্রস্তাব অনুমোদন হয়ে থাকলে, আগে অনুমোদন কারা করেছেন? আসলে লজিক্যালি আগে ও পরে সবারই না জানাটা কী অপরাধ নয়? তাহলে রক্ষক বা পাহারাদার কে? কোথায়? জবাবদিহিতা কার কাছে? অপ্রিয় সত্য হলো, আগে-পরে সবাই সবকিছু কম-বেশি জানেন, জানতেন; কারণ এর মধ্যে কেউ কেউ ‘মধুর’ ভাগীদারও আছেন!

লাগামহীন দুর্নীতির শেষ কোথায়

মিডিয়ায় যেগুলো না আসে এভাবেই কেনাকাটা চলে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট থেকে শুরু করে সরকারের ঊর্ধ্বতন সবারই পকেট ভারী হয়। আর যেহেতু এটা ঋণ, তাই সবশেষে ঋণের বোঝা জনগণের ঘাড়েই এসে পরে। কিন্তু এখন তো জানাজানি হয়েছে, তাই চলবে অস্বীকার, অপরের কাঁধে দায়ভার চাপানো, আর না জানার ভান করার খেলা। লোকদেখানো কিছু তদন্তও হয়তোবা হবে। কিন্তু দুর্নীতির মূল থাকবে বহাল তবিয়তে। কর্মকর্তারা অপেক্ষায় থাকবে নতুন কোনো হরিলুটের। উপযুক্ত বিচার না হলে ‘ঘুঘুরা তো বারবার ধান খাবেই!’ হরিলুটের খেলায় কেউ যেন পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। এভাবেই জনগণের করের পয়সার লুটপাটে চলছে উন্নয়নের খেলা। বাপের সম্পত্তিও মানুষ এভাবে লুটে-পুটে খেতে পারে না। কারণ সেখানে ভাগীদারদের বিষয় থাকে। মানুষের ট্যাক্সের টাকার সিংহভাগ এসব চোর-বাটপাড়রা লুটেপুটে খেয়ে চলছে। মানুষের কষ্টের টাকার কী ভয়ংকর লুটপাট! এই লাগামহীন দুর্নীতির শেষ কোথায় তা কেউই জানে না। দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু এরাই! 

ফ্রিল্যান্স লেখক

abunoman1972@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০