অয়নাংশ মৈত্র: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের পাশে থাকার বার্তার রানার হয়ে গত মঙ্গলবার দু’দিনের এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। এই বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে প্রথম কোনো বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ দুঃসময়ে আকস্মিক এ সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবাহী। গণভবনে দু’বছরের রোড ম্যাপ পরিকল্পনার পাশাপাশি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বাস্তুসংস্থান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুই দেশের সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। তবে অন্যতম প্রধান গুরুত্ব ছিল, কভিড-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক প্রবাহকে সচল করা। ভারতীয় সংস্থার দ্বারা করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হলে বাংলাদেশে তা সুলভ্য হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন শ্রিংলা। পরদিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন শ্রিংলার সম্মানার্থে একটি মধাহ্নভোজনের আয়োজন করেন। নিবিড় সান্নিধ্যে উষ্ণ আপ্যায়নে নিষ্পত্তি হয় এক গুচ্ছ বিষয়ের। চট্টগ্রাম ও মংলা নৌ-বন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ব্যতীত প্রোটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রেড অ্যান্ড ট্রানজিট চুক্তি ছিল এ আলাপের অন্যতম প্রধান বিষয়।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অন্য মাত্রা আনতে ‘এয়ার বাবল’ পরিষেবার প্রস্তাব দেয় ভারত। সম্প্রতি মালদ্বীপের সঙ্গে এই ব্যবস্থা চালু করেছে ভারত। দু’দেশের মধ্যে সরাসরি এয়ার বাবল পরিষেবা চালু হলে পর্যটক ও চিকিৎসার জন্য আসা জরুরি প্রয়োজনে আসা বাংলাদেশি নাগরিক ছাড়াও বিশেষভাবে উপকৃত হবেন দু’দেশের ব্যবসায়ীরা। ভারত ও বাংলাদেশের যুবসমাজের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের বিষয়টিও আলোচিত হয় এদিনের আলোচনায়। গত বছর প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশির পাসপোর্টে ভিসা দেয় ভারত।
গালয়ান সীমান্তে চীনের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের পর, প্রতিপক্ষ দুই যুযুধান উপমহাদেশে এক সংকটকালীন দুঃসময়ের আবহ তৈরি করে। নানা কৌশলে বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশীদের স্বপক্ষে আনতে চেষ্টা করে বেজিং। এর ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত আট হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। অতি সম্প্রতি তিস্তার উন্নয়নে বাংলাদেশকে দেওয়া এক বিলিয়ন ডলার ঋণ ভারতের কাছে দুশ্চিন্তার।
গত বছর ভারতের নাগরিক সংশোধনী বিল ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয় বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন স্থগিত করেন দিল্লি সফর। সংবাদমাধ্যমে ক্রমাগত নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন দু’দেশের সম্প্রীতি ও সুপ্রতিবেশী-মনস্ক আবহ বিঘিœত করে। দু’দেশের মধ্যে তৈরি হয় মনস্তাত্ত্বিক বৈরিতা। মহামারির প্রাক্কালে মুজিববর্ষের উদ্যাপন বাতিল হওয়ায় আসেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিও। দু’দেশের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্বের।
শ্রিংলার সফরে স্থির হয়, ভারত ও বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে গঠন করা হবে যৌথ পরামর্শমূলক কমিশন (জেসিসি), যা দুই দেশের সুসম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।
ঠিক এ ধরনের একটি মঞ্চ তৈরি হওয়া উচিত দু’দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীদের নিয়ে। অথবা দু’দেশের বিদেশমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীদের নিয়ে। ভারতের নতুন কর ব্যবস্থা ‘জিএসটি’ প্রবর্তিত হলেও ভারতে ব্যবসার নিয়মে রয়েছে নানা জটিলতা। জাতীয় নিয়ম ব্যতীত আছে প্রতিটি রাজ্যের প্রাদেশিক নিয়ম। দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা ঊর্ধ্বগামী হলেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে। গত আর্থিক বছরে জল, স্থল ও আকাশপথে সুসংযুক্ত থাকা দুই প্রতিবেশীর ব্যবসা ৯৭৫ কোটি মার্কিন ডলারের মাত্রা অতিক্রম করলেও এতে বাংলাদেশি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি। করোনা সংক্রমণের কারণে বেনাপোল সীমান্তের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় দু’দেশের বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়। ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে ওয়ার্ক পারমিট, সার্টিফিকেট অব অরিজিনসহ নানা বিষয়েই রয়ে গেছে জটিলতা। শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় ভারত আরও বেশি মাত্রায় পণ্য অন্তর্ভুক্তি করলে বাড়বে দু’দেশের ব্যবসা। দু’দেশের বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো নিয়ে বাণিজ্য ও বিপণন সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় বিশেষ প্রয়োজন।
ভারতের ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে সীমান্ত হাট খোলার পর অতিরিক্ত ১০টি হাট খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। ভারতীয় কোম্পানিগুলো দূরসংযোগ প্রকৌশল, ওষুধসহ নানা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) করলেও তার পরিমাণ নগণ্য।
আখাউড়া-আগরতলা সীমান্তে রেলসংযোগ বাড়াবে দু’দেশের বাণিজ্য ও সংযোগ। ভারতের আর্থিক আনুকূল্যে আগামী বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হচ্ছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী ও মোংলা-খুলনা রেলসংযোগের কাজ। আট বছর ধরে সড়ক, রেলপথ, বন্দর ও পরিকাঠামো উন্নয়নে ভারতের কাছ থেকে শুধু ঋণের সীমায় এ পর্যন্ত প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতের হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টস এবং স্মল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে নানা ধরনের সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আশা জাগছে নতুন সাম্ভবনার। মোংলা ও মিরসরাইয়ে গড়ে উঠছে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল। বাংলাদেশে প্রযুক্তি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বিপণনের মতো ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্থাগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। ঘরোয়া পণ্যদ্রব্যের বাজার ও মূল্যের অবক্ষয়ের আশঙ্কা করে বাণিজ্যমূলক মুক্ত আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি (আরসিইপি) সই করেনি নতুন দিল্লি। বাংলাদেশকে সহযোগী করে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার মূলত ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে এ রকম একটি বাণিজ্যমূলক মুক্তাঞ্চল গঠন করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে পারে ভারত। এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট, সার্ক প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট ও সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত দুটি দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যিক নিয়মের মধ্যে আছে অনেক সাযুজ্য।
মোদির বিদেশনীতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক কূটনীতি বিভাগের ওপর। মোদির ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’-এর মতো নীতিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ আরও দৃঢ় হবে বাংলাদেশের। ভারতের পরম আত্মীয় বাংলাদেশ চীনের বেল্টঅ্যান্ডরোড ইনিশিয়েটিভে সই করায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়েছে মজবুত। অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত গতিতে ধাবমান বাংলাদেশে চীনের প্রভাব ও চীনের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের প্রসার ভারতের কাছে উদ্বেগের। বিদেশ সচিবের এ সফরের পর নতুন দিল্লি ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিপণনের রাস্তা প্রশস্ত করার প্রয়াসে তৎপর হবে বলেই আশা রাখা যায়। দু’দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি দু’দেশের সুসম্পর্ককে করবে আরও সুসংবদ্ধ ও সুসংযত। প্রতিবেশীকে বাণিজ্যিক অংশীদার করে আর্থিকভাবে সুদৃঢ় হয়েছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আগের দুই দেশ।
(ভারতীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক অয়নাংশ মৈত্র, ঢাকার থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিসের সঙ্গে যুক্ত। টুইটারে সক্রিয় Ayanangsha )