ফজলে রাব্বি: নববর্ষে প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ মনে হয় আজও অল্পস্বল্প চালু আছে বাংলাদেশে। ১৯৮৩ সালে গ্রন্থকেন্দ্র এ রেওয়াজ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল। পরবর্তীতে তা চাপা পড়ে যায় রমনা বটতলার পান্তা-ইলিশে, আর্ট কলেজের মুখোশ নৃত্যে আর শাড়ি ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়। তবু দু’-একজন প্রকাশক ও কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা বাংলা বছরের প্রথম দিনে প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়ার প্রথা চালু রেখেছিল। এদের মধ্যে ইউপিএলের নাম বলা যায়। তবে এটা বাঙালির জাতীয় প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি।
নববর্ষে মিষ্টি ও শাড়ি কাপড়ের পাশে বইও স্থান করে নিতে পারতো। দুঃখের বিষয় পারেনি। সম্ভবত ৮০ শতাংশ মানুষই বই পড়েন না। তাদের প্রভাব অজান্তে আমাদের ওপরও পড়ে। ভুলে যাই, আমরা বই পড়তে পারি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির আচরণে বই পড়ার প্রকাশ খুব একটা দেখা যায় না। বরং অর্থ বৈভব ও ক্ষমতার উৎকট বহিঃপ্রকাশ চোখে পড়ে। তাই দেশে যতদিন না শতকরা শতভাগ শিক্ষিত হচ্ছে, ততদিন আমাদের মনে করিয়ে দিতে হবে, আমরা পড়তে পারি, আমরা শিক্ষিত। শিক্ষা ও অশিক্ষার একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে বই। নববর্ষে সেই সুযোগ আসে।
নববর্ষে প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়া সামাজিক প্রথা বা রেওয়াজে পরিণত করতে পারলে বাংলাদেশি বইয়ের অবস্থা কী হতে পারতো, তা কল্পনাও করা যায় না। মাত্র একদিনে হাজার হাজার বই লেনদেন হতো। যারা বই পড়ে না বা যারা বই পড়তে পারে না তারাও উপহার হিসেবে বই কিনতো। সবখানে বইয়ের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যেত। বইয়ের দোকান সাজানো হতো নানা বর্ণে ও শোভায়। ঘরে ঘরে শিশুরা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতো, বাবা-মায়ের কাছ থেকে এ দিনে কোনো না কোনো বই উপহার পাওয়ার আশায়। বন্ধু আশা করতো, বন্ধুর কাছ থেকে একটা বই। ইংরেজি নববর্ষে যেমন সবাই ডায়েরি কিংবা ক্যালেন্ডারের আশা করে, তেমনি বাংলা নববর্ষে সবাই একটা বা দুটো বই আশা করতো নানা ব্যাংক বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
সরকার এগিয়ে এলে কাজটা সহজ হতো। সরকার তো আমাদেরই প্রতিচ্ছায়া। আমি ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগতভাবে বাংলা নববর্ষে প্রিয়জনকে বই উপহার দিয়ে উদযাপন শুরু করলে আরও দশজন এগিয়ে আসবে। এভাবে সরকারও একদিন এগিয়ে আসবে।
আমরা প্রত্যেকেই আপনজনকে এ দিনে যদি একটা বই উপহার দিই, তাহলে নিজের বাড়ি থেকেই একটা ভালো কাজের সূচনা হয়। নিজে যেমন আপনজনকে একটা বই উপহার দিতে পারি, তেমনি অপরকে বলতে পারি তার আপনজনকে একটা বই উপহার দিতে। পাঠক, লেখক, প্রকাশক, বিক্রেতা সবাইকে এ প্রথা চালু করার জন্য আন্তরিক হতে হবে। গ্রন্থাগারগুলোকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। চৈত্র মাস থেকে এর প্রচারণা আরম্ভ করা প্রয়োজন।
কানাডা, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ায় বইয়ের জন্য এমন করে একটি দিন বা একটি মাসকে বইয়ের জন্য বরাদ্দ করার প্রস্তাব করতে হয় না। কারণ তাদের সংস্কৃতিতে নিত্যদিনের একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ বই। বই তাদের কাছে প্রতিদিনের বিষয়। তারা সবাই বই পড়তে পারে। সবাই বই পড়ে।
আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে বাংলা ভাষা উন্নয়নের প্রতীক করে বইমেলা চালু করলাম। অথচ বাংলাদেশের বইকে, বইয়ের বাজারকে সবার অজান্তে আদিমতা ও বইবিমুখতার প্রভাবে সীমাবদ্ধ করলাম সীমিত সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে। কেন এমন হলো, তা মধ্যবিত্ত শ্রেণি বুঝতে পারলো না। ফলে বইকে সহজে উৎসব ও আনন্দে সম্পৃক্ত করতে পারলাম না।
সাবেক পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলা একাডেমির প্রকাশন-বিক্রয় ও মুদ্রণ বিভাগ
Add Comment