রহমত রহমান: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ফলে অর্থনীতির আকার বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আহরণের সম্ভাবনা বাড়ছে। বাংলাদেশের করযোগ্য এক-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এখনও কর আওতার বাইরে। অটোমেশন না হওয়ায় করযোগ্য সব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে কর আওতায় আনা যাচ্ছে না। উন্নত দেশগুলো তো বটেই, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম। এ হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে না প্রত্যাশিত হারে।
তবে আশার কথা হলো, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ ব্যয় সবচেয়ে কম। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছর লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে আহরণ যেমন বাড়ছে, তেমনি আহরণ ব্যয়ও কমে আসছে। এনবিআর পুরোপুরি অটোমেশন হয়ে গেলে রাজস্ব ফাঁকি কমে যাবে। করনেট সম্প্রসারিত হবে। করযোগ্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান করের আওতায় চলে আসবে। রাজস্ব আহরণ তিনগুণ বেড়ে যাবে, সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমে যাবে রাজস্ব আহরণ ব্যয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, ২০০০-০১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রাজস্ব জিডিপি ছিল ৯.১৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৪০ শতাংশ। ২০০০-০১ অর্থবছরে কর রাজস্ব জিডিপি ছিল ৭.৮০ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৪০ শতাংশ। আবার ২০০০-০১ অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব জিডিপি ছিল ৭.৪০ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.১০ শতাংশ।
এনবিআরের গত সাত অর্থবছরের রাজস্ব আহরণের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর রাজস্ব আহরিত হয়েছে এক লাখ ৯ হাজার ১৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ কর আহরণে প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে ৫৮ পয়সা, পরোক্ষ কর আহরণে ব্যয় হয়েছে এক টাকা ৯ পয়সা। ওই অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আহরণে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৮৩ পয়সা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ কর আহরণে ৫৮ পয়সা, পরোক্ষ কর আহরণে ৪৮ পয়সা এবং গড়ে ৫৩ পয়সা ব্যয় হয়েছে। ২০১৪-১৪ অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ কর আহরণে ৫৫ পয়সা, পরোক্ষ কর আহরণে ৪৬ পয়সা এবং গড়ে ৫০ পয়সা ব্যয় হয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ কর আহরণে ১ টাকা ১০ পয়সা, পরোক্ষ কর আহরণে ৪৮ পয়সা এবং গড়ে ৭৯ পয়সা ব্যয় হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ কর আহরণে ১ টাকা ১০ পয়সা, পরোক্ষ কর আহরণে ৪৭ পয়সা এবং গড়ে ৭৮ পয়সা ব্যয় হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ কর আহরণে ৭৫ পয়সা, পরোক্ষ কর আহরণে ৫০ পয়সা এবং গড়ে ৬২ পয়সা ব্যয় হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকার প্রত্যক্ষ কর আহরণে ৭০ পয়সা, পরোক্ষ কর আহরণে ৪২ পয়সা এবং গড়ে ৫৯ পয়সা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর আহরণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয় কমে আসছে।
অন্যদিকে ওইসিডি ২০১৫ সালে বিশ্বের ৬০টি দেশের ২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের ব্যয় নিয়ে গবেষণা করে। এর মধ্যে ওইসিডি ৩৮টি সদস্য দেশ ও সদস্য নয় এমন ২২টি দেশ রয়েছে। ওইসিডিভুক্ত ৩৮টি দেশের ২০১৩ সালের রাজস্ব আহরণের ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায়, ৩৮টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশে বাংলাদেশি টাকায় প্রতি ১০০ টাকার রাজস্ব আহরণে এক টাকার বেশি ব্যয় হয়। এর মধ্যে বেলজিয়াম ১ টাকা ১৭ পয়সা, কানাডা ১ টাকা ১৫ পয়সা, চেক প্রজাতন্ত্র ১ টাকা ৩১ পয়সা, ফ্রান্স ১ টাকা ১১ পয়সা, জার্মানি ১ টাকা ৩৫ পয়সা, ইতালি ১ টাকা ৫ পয়সা, জাপান ১ টাকা ৭৪ পয়সা, পোল্যান্ড ১ টাকা ৬০ পয়সা, সেøাভাকিয়া ১ টাকা ৪৩ পয়সা।
ওইসিডিভুক্ত ২৮টি দেশে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণে ব্যয় ১ টাকার কম। এর মধ্যে রয়েছেÑঅস্ট্রেলিয়া ৯৩ পয়সা, অস্ট্রিয়া ৬৭ পয়সা, চিলি ৬৬ পয়সা, ডেনমার্ক ৪৮ পয়সা, ইসতোনিয়া ৪০ পয়সা, ফিনল্যান্ড ৭৫ পয়সা, আইল্যান্ড ৮৫ পয়সা, ইসরাইল ৯৪ পয়সা, কোরিয়া ৭৪ পয়ষা, লুক্সেমবার্গ ৯৩ পয়সা, মেক্সিকো ৬৯ পয়সা, লেদারল্যান্ড ৯৫ পয়সা, নিউজিল্যান্ড ৮৫ পয়সা, নরওয়ে ৪১ পয়সা, পর্তুগাল ৯৯ পয়সা, সেøাভেনিয়া ৮৯ পয়সা, স্পেন ৬৭ পয়সা, সুইডেন ৩৯ পয়সা, সুইজারল্যান্ড ২৯ পয়সা, তুর্কি ৬৪ পয়সা, ইউকে ৭৪ পয়সা ও যুক্তরাষ্ট্র ৪৭ পয়সা।
ওইসিডি সদস্য নয় এমন ২২টি দেশের মধ্যে ৯টি দেশে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণের ব্যয় ১ টাকার বেশি। এর মধ্যে বুলগেরিয়া ১ টাকা ২৫ পয়সা, কোস্টারিকা ১ টাকা ১৯ পয়সা, সাইপ্রাস ১ টাকা ১৬ পয়সা, লাটভিয়া ১ টাকা ৬ পয়সা, মালয়েশিয়া ১ টাকা, রোমানিয়া ১ টাকা ২১ পয়সা, সৌদি আরব ১ টাকা ৬২ পয়সা ও দক্ষিণ আফ্রিকা ১ টাকা ৫ পয়সা। বাকি ১৩টি দেশে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণে ব্যয় ১ টাকার কম। এর মধ্যে রয়েছেÑআর্জেন্টিনা ৯৫ পয়সা, ব্রাজিল ৮০ পয়সা, কলম্বিয়া ৫৬ পয়সা, কোস্টিয়া ৮০ পয়সা, চায়না ৬৬ পয়সা, ভারত ৫৭ পয়সা, লিথুনিয়া ৮১ পয়সা, ইন্দোনেশিয়া ৫৬ পয়সা, মাল্টা ৯৫ পয়সা, রাশিয়া ৮১ পয়সা, সিঙ্গাপুর ৭৯ পয়সা ও থাইল্যান্ড ৭১ পয়সা।
অন্যদিকে এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, ওই অর্থবছর রাজস্ব আহরিত হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার ৭৭১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৩৫২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণের প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে (পুরস্কার, ব্যান্ডরোল ও স্ট্যাম্প মুদ্রণ ব্যয়সহ) ৬১ পয়সা। আর স্ট্যাম্প, সার্টিফিকেট, বন্ড মুদ্রণ ব্যতীত প্রশাসনিক ব্যয় এক হাজার ২৯৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ব্যান্ডরোল ও স্ট্যাম্প মুদ্রণ ব্যয় ব্যতীত প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণের প্রশাসনিক ব্যয় ৫৯ পয়সা।
২০১৮-১৯ অর্থবছর রাজস্ব আহরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের প্রশাসনিক ব্যয় হিসাব করলে দেখা যায়, ওই অর্থবছর প্রত্যক্ষ কর আহরণ হয়েছে ৭০ হাজার ২০১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এতে প্রশাসনিক ব্যয় (পুরস্কার, ব্যান্ডরোল ও স্ট্যাম্প মুদ্রণ ব্যয়সহ) হয়েছে ৪৮৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণে প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে ৭০ পয়সা। প্রশাসনিক ব্যয় (স্ট্যাম্প, সার্টিফিকেট, বন্ড মুদ্রণ ব্যয় ব্যতীত) ৪৮৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণে প্রশাসনিক ব্যয় ৬৯ পয়সা।
একই অর্থবছর পরোক্ষ কর আহরণ হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার ৫৭০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে (পুরস্কার, ব্যান্ডরোল, স্ট্যাম্প ?মুদ্রণ ব্যয়সহ) ৬২৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণে ব্যয় হয়েছে ৪২ পয়সা। প্রশাসনিক ব্যয় (স্ট্যাম্প, সার্টিফিকেট, বন্ড মুদ্রণ ব্যয় ব্যতীত) ৫৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রশাসনিক ব্যয় ৩৭ পয়সা।
গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকা প্রত্যক্ষ কর আহরণে প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে ৭০ পয়সা, আর প্রতি ১০০ টাকা পরোক্ষ কর আহরণে ব্যয় হয়েছে ৪২ পয়সা। গড়ে ওই অর্থবছর প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আহরণে প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে ৫৬ পয়সা।
এনবিআরের একাধিক সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতি বছর এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আহরণ বাড়ছে। ফলে আহরণ ব্যয়ও কমে আসছে। তবে এনবিআর কাক্সিক্ষত রাজস্ব আহরণ করতে পারে না। অটোমেশন হয়ে গেলে রাজস্ব ফাঁকি রোধ হবে, করনেট বাড়বে। রাজস্ব আহরণ বেড়ে যাবে অন্তত তিনগুণ। ফলে আহরণ ব্যয় আরও অনেক কমে আসবে।