ডা. শরীফ মো. রুহুল কুদ্দুস: অল্প কিছুতেই টেনশনে ভুগতে থাকেন চল্লিশোর্ধ্ব ফয়জুননেসা। স্বামী অফিস থেকে ফিরতে দেরি করছে, সন্তারা সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করছে না, মোবাইল ফোনে গেমস খেলছে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল টেনশন। দিনে বা রাতে কারণে-অকারণে টেনশন তার নিত্যসঙ্গী। স্বামী ও সন্তানরা এ নিয়ে খুব বিরক্ত। করোনা শুরু হওয়ায় তার টেনশন আরও বেড়ে যায়। কিছুদিন পর খাওয়া-দাওয়া কমে যেতে থাকে ফয়জুননেসার। কয়েক মাসের মধ্যে তিনি দৈনন্দিন কাজকর্ম করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। রাতে ঘুম কমে যায়, শুধু হাঁটাহাঁটি করেন, রান্নাঘরে চুলা বন্ধ কি না, বারে বারে দেখেন। এই উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায়, তাকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন মারাত্মক মানসিক রোগে আক্রান্ত ফয়জুননেসা।
যে কোনো দুর্যোগে বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বিপদাপন্ন এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকে। তাই করোনাকালীন মহামারিতে পরিবারে নারীর প্রতি অধিক যতœবান হতে হবে। এ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব আমাদের মনের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করেছে, যা অনেকের নিয়মিত ঘুমে ব্যাহত ঘটছে। এই মহামারির সময়টিতে পর্যাপ্ত ঘুম খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিদিন অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে, যা আমাদের মন ও শরীর দুটোই ভালো রাখবে।
করোনার কারণে সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার বিষয়টি মানুষের মনে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করছে। শিশুদের ক্ষেত্রে সম্মিলিত বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। এই সময় বাড়ির শিশু ও বয়স্কদের বিশেষভাবে যতœ নিতে হবে। বয়ষ্ক মানুষটি হঠাৎ শিশুর মতো অবুঝ হয়ে উঠতে পারেন। শিশুরা খিটখিটে ও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তাদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে, বিশেষ করে তাদের সামনে কোনো ধরনের ঝগড়া ও সহিংসতা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
অনেক পরিবারে নারীই প্রাথমিক ও একমাত্র সেবাদানকারী। যে কোনো সংকটে তার কাজের চাপ ও মানসিক চাপ বহুগুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের বিষন্নতা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাদের প্রয়োজনগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে এবং সহযোগিতা করতে হবে। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা পরিহার করতে হবে।
শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আমরা তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি না। টেনশন, ডিপ্রেশন প্রভৃতি মানসিক রোগ কিন্তু আমাদের চারপাশের মানুষের মধ্যে থাকতে পারে। দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী কোনো ব্যক্তি যে কোনো সময় মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মানসিক সমস্যার সঙ্গে শুধু শারীরিক নয়, আর্থ-সামাজিক কারণও জড়িয়ে থাকে। ক্যারিয়ারের টানাপড়েন, পারিবারিক সংকট, বেকারত্ব, অসুস্থতা, পরিবারের কোনো সদস্যের অসুস্থতা, আর্থিক সংকট, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল ব্যবধান মানুষকে হতাশাগ্রস্ত ও বিষণœ করে তুলতে পারে। মেজাজ হয়ে উঠতে পারে কর্কশ বা খিটখিটে। আবার ডিমেনশিয়া, আলঝেইমার প্রভৃতি রোগও হতে পারে বংশগত কারণে। এগুলোকে অনেক সময় প্রাথমিক অবস্থায় রোগ বলে চিহ্নিত করা হয় না। ফলে দিনে দিনে রোগটি বেড়ে যায়। চলে যায় আয়ত্তের বাইরে। অথচ প্রাথমিক অবস্থায় মানসিক রোগের যথাযথ চিকিৎসা হলে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, রোগকে রাখা যায় নিয়ন্ত্রণে। সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ মানুষকে বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ থেকে আমাদের নারী, শিশুসহ তরুণ প্রজš§কে রক্ষা করা দরকার।
করোনাভাইরাসের সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে বাগান করা, পোষা পশুপাখিকে আদর করলেও ভালো অনুভূত হয়। যারা একা থাকেন বা যাদের পোষা পশুপাখি নেই, তাদের জন্য নিয়মিত ঘুম, শরীর চর্চা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা, ভার্চুয়ালি আত্মীয়স্বজন, কাছের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, নাচ, গান, সিনেমা দেখার মতো বিনোদন, ছবি আঁকা, বাগান করা, এমনকি রান্না করাও মানসিক চাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া সৃষ্টিশীল কাজ ও অন্যকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েও মন ভালো রাখা যায়।
সারাবিশ্বে পাঁচ থেকে ১৭ শতাংশ মানুষ বিষণœতায় ভুগছে। ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেলথ সার্ভের প্রতিবেদন ২০১৯ এ দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে পাঁচ শতাংশ মানুষ বিষণœতায় আক্রান্ত। শিশুদের মধ্যে এ হার এক শতাংশ। দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বিষণœ তায় ভুগছে। করোনাকালে এ হার বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে দেশে পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বিষণœতার হার প্রায় দ্বিগুণ। বিষন্নতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন, সৃজনশীলতা। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসাব অনুযায়ী সারাবিশ্বে প্রতিদিন বিষণœ তার কারণে তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। শুধু বিষণœতা নয় উদ্বেগ, সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগও রয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশের ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১৭ শতাংশ এবং পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু কিশোরদের ১৪ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। মানসিক রোগ নিয়ে আমাদের সমাজে বেশকিছু কুসংস্কার রয়েছে। ভূত-প্রেত বা জিনের আছরের কারণে রোগী অস্বাভাবিক আচরণ করছে এমনটি হরহামেশাই মনে করা হয়। অনেক সময় মানসিক রোগীকে ওঝা বা হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক প্রভৃতির মাধ্যমে রোগীকে আরোগ্য করার চেষ্টা করা হয়। ফলাফল হয় আরও খারাপ। রোগ তো ভালো হয়ই না উল্টো রোগীর জীবন সংশয় দেখা দেয়। মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে বিশেষ করে নারীরা বেশি সামাজিক সমস্যায় পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীরা মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে তাদের যথাযথ চিকিৎসা তো হয়ই না, উপরন্তু তাদের ওপর নির্যাতন বাড়ে এমনকি তালাক পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হয়।
নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর জন্যও কাউন্সেলিং জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে অনেক নারী বিষণœতাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হতে পারে শিশুরাও। তাদের সবার জন্যই দরকার কাউন্সেলিং। যেসব নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, তাদের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে কাউন্সেলিং প্রয়োজন। গর্ভধারণ ও সন্তান জš§দানের পর নারীদের এক বিশেষ ধরনের বিষণœতায় ভুগতে দেখা যায়। হরমোন-সংক্রান্ত কারণেও বিষণœতায় আক্রান্ত হতে পারেন অনেক নারী।
মানসিক রোগের চিকিৎসা শুধু ওষুধ নির্ভর নয়, অনেকটাই কাউন্সেলিং নির্ভর। মানসিক রোগের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকায় ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার এবং দেশব্যাপী আটটি রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এসব সেন্টার থেকে নারী ও শিশুকে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে। কেউ অস্বস্তিতে ভুগছে কি না, সেটিও চেকআপ হয়, পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষকসহ কাউন্সেলিং সম্পর্কিত সচেতনতা, মৌলিক দক্ষতা, কমিউনিটি এবং সাপোর্টিভ কাউন্সেলিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষাও খুবই জরুরি।
বর্তমান সরকার মানসিক রোগীদের অধিকার রক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ঢাকা, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মনোরোগবিদ্যা বিভাগে মানসিক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল সাইকোলজি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, কাউন্সেলিং ও এডুকেশনাল সাইকোলজি এবং মনোবিজ্ঞান বিভাগও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগেও একই সেবা কমবেশি চলমান রয়েছে। ব্যক্তির শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সরকারের বিশেষ সুদৃষ্টি দেশের ভবিষ্যৎ সুস্থ সুনাগরিক গড়ে তোলার পথে অন্যতম জরুরি পদক্ষেপ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্তি বর্তমান সরকারের বড় কৃতিত্ব। এ পদক্ষেপ দেশজুড়ে জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার সবক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ জানিয়েছেন। ফলে অজ্ঞতা, কুসংস্কার কিংবা ভুল ধারণা দূর করে মানসিক স্বাস্থ্যের যতেœর প্রতি সচেতন হবে দেশের জনগোষ্ঠী। কোনো মানুষকে পেছনে ফেলে নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার যে প্রচেষ্টা প্রধানমন্ত্রী চালিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের উচিত; তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা।
পিআইডি নিবন্ধ