ইসমাইল আলী: তিন বছর আগে এক হাজার মেগাওয়াটের ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় সরকার। চাহিদা না থাকায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই এসব কেন্দ্র বসে থাকছে। এতে কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ছে অনেক বেশি। তবে করোনার কারণে গত অর্থবছর বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কমে যায়। যদিও এ সময় উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে কেন্দ্রগুলোর জন্য। ফলে ডিজেলচালিত এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়েছে অস্বাভাবিক বেশি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছিল ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে নির্মিত এপিআর এনার্জির কেন্দ্রটি। ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আইপিপি কেন্দ্রটিতে বছরে কমপক্ষে ২১৬ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অথচ গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে মাত্র ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা সক্ষমতার এক শতাংশের কম। যদিও কেন্দ্রটির জন্য এ সময় ৫৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় পিডিবিকে। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি এক হাজার ৫৭৯ টাকা ৫৭ পয়সা। এটি দেশে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে স্থাপিত প্যারামাউন্ট বিট্রাক এনার্জি কেন্দ্রটি। এর উৎপাদন ক্ষমতা ২০০ মেগাওয়াট। ডিজেলচালিত এ কেন্দ্রটি থেকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় মাত্র ৩৭ লাখ ৫৬ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা। যদিও কেন্দ্রটিতে বছরে কমপক্ষে ১৪৪ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সক্ষমতার এক শতাংশের কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও গত অর্থবছর কেন্দ্রটির জন্য ৩৪৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে পিডিবিকে। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৯৪৪ টাকা ২১ পয়সা।
একই অবস্থা কুমিল্লার দাউদকান্দিতে স্থাপিত বাংলা ট্র্যাকের ২০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির। এ কেন্দ্রে বছরে কমপক্ষে ১৪৪ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছর এ কেন্দ্রটিতে মাত্র ৫৯ লাখ ৯২ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সক্ষমতার এক শতাংশেরও কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও গত অর্থবছর কেন্দ্রটির জন্য ৩৫১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় পিডিবিকে। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৬০৬ টাকা আট পয়সা।
ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের ব্রাহ্মণগাঁওয়ে নির্মিত এগ্রিকো পাওয়ার সল্যুশন কেন্দ্রটিও গত অর্থবছর বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ ছিল। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বছরে ৭২ কোটি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। যদিও মাত্র ৪৬ লাখ ৭৬ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রটির জন্য গত অর্থবছর ১৭৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৩৯৪ টাকা ৫৩ পয়সা।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের একই ধরনের চিত্র ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের ওরাহাটিতে নির্মিত এগ্রিকো আরেক কেন্দ্র এনার্জি সল্যুশন লিমিটেডের। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও গত অর্থবছর বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ ছিল। ফলে মাত্র ৬০ লাখ ৪১ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে কেন্দ্রটির জন্য গত অর্থবছর ১৭৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৩০৭ টাকা ২৬ পয়সা।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ডিজেলের বিদ্যুৎকেন্দ্র রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে উঠেছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে ভাড়াভিত্তিক কয়েকটি কেন্দ্র ছিল ডিজেলচালিত। দ্রুত উৎপাদন শুরুর জন্য এসব কেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তবে কোনো প্রয়োজন ছাড়াই তিন বছর আগে নতুন করে আরও ছয়টি কেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের একটি কেন্দ্রে কিছুটা বিদ্যুৎ করা হয়। বাকিগুলো বসিয়ে বসিয়েই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। এতে অস্বাভাবিকভাবে উৎপাদন ব্যয় পড়েছে। তবে আশার কথা হলো, এসব কেন্দ্রের মেয়াদ আছে আর মাত্র দুই বছর। এরপর এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, তিন বছর আগে লাইসেন্স দেওয়া ডিজেলচালিত দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যশোরের নওয়াপাড়ায় অবস্থিত। বাংলা ট্র্যাকের ১০০ মেগাওয়াটের (দ্বিতীয় ইউনিট) এ কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সাত কোটি ৮৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার প্রায় ৯ শতাংশ। এতে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে গেছে। গত অর্থবছর এ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়েছে ৩৯ টাকা ৩০ পয়সা। অথচ এ কেন্দ্রটিরও ক্যাপাসিটি চার্জ ১৭৫ কোটি টাকার বেশি।