ক্যাপাসিটি চার্জ

বিদেশি ৭ কোম্পানি নিয়ে গেছে ১৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা

বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। এতে বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝাও। গত এক দশকে শুধু এ চার্জ থেকেই প্রচুর আয় করেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ এক দশকে কোন কোম্পানি কত আয় করেছে, তা সম্প্রতি অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব

ইসমাইল আলী: গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে দেশীয় কোম্পানির পাশাপাশি কিছু বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। আবার ২০১০ সালের আগেও বাংলাদেশে কয়েকটি বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। সব মিলিয়ে বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দুই হাজার ১৫ মেগাওয়াট। আর এসব কেন্দ্রের জন্য এক দশকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০১০-১১ অর্থবছর বাংলাদেশের ছয়টি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এ কোম্পানিটির কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩৯০ মেগাওয়াট। আর সে অর্থবছর এ ছয় কেন্দ্রের জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৪৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। পরের (২০১১-১২) অর্থবছর এগ্রিকোর কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাতে। আর উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ৫৩৫ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ৯৮৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

যদিও ২০১২-১৩ অর্থবছর এগ্রিকোর দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল। এতে পাঁচটি কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কমে দাঁড়ায় ৩৯০ মেগাওয়াট। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই অর্থবছর এগ্রিকোকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় এক হাজার সাত কোটি ১২ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরও কোম্পানিটির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা একই ছিল। তবে উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ কমে দাঁড়ায় ৯৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর এগ্রিকোর ৪০ মেগাওয়াটের একটি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। তবে অপর দুটি কেন্দ্রের সক্ষমতা ১৫ মেগাওয়াট করে বাড়ানো হয়। এতে এগ্রিকোর কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ৩৮০ মেগাওয়াট। আর এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় এক হাজার ৫১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরও এগ্রিকোর কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা একই ছিল। তবে উৎপাদন কমে যাওয়ায় এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ কমে যায়। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পিডিবি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে ৫৭৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, আর ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৪৭১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষ দিকে এগ্রিকোর ১০০ মেগাওয়াটের আরেকটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসে। এতে কোম্পানিটির কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ৪৮০ মেগাওয়াট। তবে উৎপাদন আরও কমায় ক্যাপাসিটি চার্জ কমে দাঁড়ায় ৪০৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছর এগ্রিকোর ১৪৫ মেগাওয়াটের আরেকটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। তবে ১০০ মেগাওয়াটের আরেকটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসে। যদিও নির্ধারিত সময়ে উৎপাদনে আসতে না পারায় কেন্দ্রটিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের বদলে ৩০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ফলে ওই অর্থবছর কোম্পানিটিকে সার্বিকভাবে পরিশোধিত ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর এগ্রিকোর ১৪০ মেগাওয়াটের আরও দুটি কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এতে কোম্পানিটির তিন কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমে দাঁড়ায় ২৯৫ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে কোম্পানিটিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ৪৯৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর সব মিলিয়ে এক দশকে কোম্পানিটির পকেটে গেছে ছয় হাজার ৭৯৫ কোটি তিন লাখ টাকা।

যদিও বাংলাদেশ থেকে এগ্রিকো ক্রমেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে বলে জানান পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে খুবই সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে এগ্রিকো। তাদের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতাও ভালো। তবে অন্যান্য দেশি কোম্পানির চুক্তি বারবার নবায়ন করা হলেও এগ্রিকোর কেন্দ্রগুলোর চুক্তি বাড়ানো হয়নি। এছাড়া দেশীয় অন্যান্য কোম্পানির চেয়েও সুযোগ কম পাচ্ছে কোম্পানিটি। তাই ধীরে ধীরে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।

এদিকে বেসরকারি খাতে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এইএস (অ্যালাইড এনার্জি সিস্টেম) করপোরেশন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে। তবে ২০০৩ সালে তারা কেন্দ্রটি যুক্তরাজ্যের সিডিসি গ্লোবলাকের কাছে বিক্রি করে দেয়। আর ২০০৭ সালে সিডিসি গ্লোবলাক এ কেন্দ্রটি মালয়েশিয়ার পানডেকার এনার্জির কাছে বিক্রি করে দেয়।

গ্যাসচালিত ৪৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটির জন্য গত এক দশকে (২০১০-১১ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর) পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে তিন হাজার ৭২৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

মেঘনাঘাট আইপিপির আগে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে বিদেশি বিনিয়োগের আইপিপি হরিপুর পাওয়ার প্লান্ট। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এইএস করপোরেশন ২০০১ সালে গ্যাসচালিত ৩৬০ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে। গত এক দশকে এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে এক হাজার ৭৯৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

যদিও বাংলাদেশে বেসরকারি তথা বিদেশি বিনিয়োগের প্রথম আইপিপি (বিদ্যুৎকেন্দ্র) হরিপুর বার্জমাউন্টেড পাওয়ার প্লান্ট। ১৯৯৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউ ইংল্যান্ড পাওয়ার কোম্পানি। ২০ বছর মেয়াদি এ কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর। এতে ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ৯ বছরে কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে এক হাজার ১৯৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাংলাদেশে ৩০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি। ডিজেলচালিত এ কেন্দ্রটির জন্য দুই অর্থবছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে এক হাজার ৪৭ কোটি টাকা। যদিও চাহিদা না থাকায় গত অর্থবছর এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে নামমাত্র উৎপাদন করা হয়।

ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে নির্মিত কেন্দ্রটি সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হলে বছরে কমপক্ষে ২১৬ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অথচ গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে মাত্র ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা সক্ষমতার এক শতাংশের কম। তবে এ সময় কেন্দ্রটির জন্য ৫৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় পিডিবিকে। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি এক হাজার ৫৭৯ টাকা ৫৭ পয়সা। এটি দেশে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

এদিকে ২০১৪-১৫ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কোম্পানি লক্ষধনবি। এ কোম্পানির ৫২ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির জন্য ছয় বছরে ৩৭৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া লক্ষধনবির সহযোগী রাজলঙ্কা পাওয়ার বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। ৫২ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রটির জন্য সাত বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৪৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

গত অর্থবছর ফেনীলঙ্কা নামে ১১৪ মেগাওয়াটের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে নির্মাণ করেছে লক্ষধনবি। এ কেন্দ্রের জন্য ৭৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে লক্ষধনবি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে ৮৯৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

এর বাইরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্প ২৮২ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। দুই বছরে কেন্দ্রটির জন্য কোম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৮২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০