রহমত রহমান: কাস্টমস দিবস উদযাপনে ছিলেন ব্যস্ত কর্মকর্তারা। এই সুযোগে সিগারেটভর্তি কনটেইনার বন্দর থেকে বের করার চেষ্টা করেছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স খায়ের ব্রাদার্স। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তাদের তৎপরতায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঘোষণা ছিল ‘ড্রাই মাশরুম’। কিন্তু আমদানি হয়েছে সিগারেট। আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের যোগসাজশে রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা করা হয়েছে।
সিঅ্যান্ডএফের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে সম্প্রতি এ লাইসেন্স বাতিল করা হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। খায়ের ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চালানটির রপ্তানিকারক মালয়েশিয়ার নিউ সাইন করপোরেশন। তবে চালানটি চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার আমদানিকারক বাংলা ভিনা এন্টারপ্রাইজ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করে। এই চালানের জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭ হাজার ৩৩৫ মার্কিন ডলারের। চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর গত ৫ জানুয়ারি খালাসের প্রক্রিয়া শুরু করেন আমদানিকারক। শুল্কায়নের পর আমদানিকারকের প্রতিনিধি খায়ের ব্রাদার্স ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকার শুল্ক পরিশোধ করেন।
সূত্র আরও জানায়, পণ্য চালানটিতে রাজস্ব ফাঁকি বিষয়ে তথ্য থাকায় অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে তা লক করা হয়। পরে আমদানিকারকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ জানুয়ারি শতভাগ কায়িক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। কিন্তু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাস্টমস কর্মকর্তাদের না জানিয়ে ২৩ জানুয়ারি চালানটি খালাসের জন্য নিয়ে যায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টম হাউসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআরআই) শাখার কর্মকর্তারা ৪০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার চালানটি আটক করলে সিঅ্যান্ডএফের কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। পরে কাস্টমস কর্মকর্তারা কনটেইনার খুলে ১৬ হাজার ৩০০ কেজি শুকনা মাশরুমের পরিবর্তে ঘোষণাবহির্ভূত এক কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার শলাকা বিভিন্ন ধরনের বিদেশি সিগারেট পান, যার আনুমানিক মূল্য ২৫ কোটি টাকা।
পণ্য আটকের পর এআইআর শাখার সহকারী কমিশনার নুর এ হাসনা সানজিদা অনুসুয়া বলেন, কাস্টমস দিবস উপলক্ষে সবাই যখন র্যালিতে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই সময়টাকেই চোরাচালান চক্রটি বেচে নেয়। পরে দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তা বিষয়টি ধরে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে আগে থেকেই চালানটি নিয়ে গোপন তথ্য ছিল। সে জন্য আমরা চালানটি লক করে রেখেছি। লক বা বন্ধ করা চালান একটি সিঅ্যান্ডএফ কীভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইনডেন্ট বা ছাড়ের অনুমতি নিয়ে কনটেইনার বের করার চেষ্টা করল সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। চালানটিতে থাকা সিগারেটের মূল্য ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। শর্তসাপেক্ষে এই চালান খালাস করতে হলে শুল্ককর দিতে হতো ২১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।’
সূত্র আরও জানায়, আমদানিকারকের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টও ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আমদানির বিষয়ে জানত। সিঅ্যান্ডএফ অবগত থাকার পরও কাস্টমসকে অবহিত না করে পণ্য খালাস কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯ ফেব্রুয়ারি খায়ের ব্রাদার্সের লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করা হয়। একইসঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়। ১০ মার্চ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জবাব দেয়। একইসঙ্গে লাইসেন্স বাতিল বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে। আদালতের নির্দেশনা ও প্রতিষ্ঠানের জবাবের আলোকে ১৬ সেপ্টেম্বর সিঅ্যান্ডএফের ব্যক্তিগত শুনানি নেওয়া হয়। শুনানিতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের স্বত্বাধিকারী এসএমএ খায়ের ও লাইসেন্সিংয়ের সদস্য সচিব উপস্থিত ছিলেন।
শুনানিতে এসএমএ খায়ের বলেন, এর আগে আমদানিকারক বাংলা ভিনা এন্টারপ্রাইজের কোনো কাজ তারা করেননি। তবে মাশরুম ঘোষণায় সিগারেট আমদানির বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। এসএমএ খায়ের জানান, বিল অব এন্ট্রি দাখিল করতে এজেন্ট আইডেন্টিফিকেশন নাম্বারের (এআইএন) পাসওয়ার্ড লাগে। ৫ জানুয়ারি তিনি বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেননি। তার নামে কেউ বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেছে। তিনি বন্দর থানায় লাইসেন্স জালিয়াতির অভিযোগে মামলা করেছেন। কোনো জালিয়াত চক্র তার পাসওয়ার্ড জেনে তা ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে জানান। তবে কে ব্যবহার করেছে, কার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সে বিষয়ে কোনো জবাব দিতে পারেননি খায়ের। দেখা যায়, পণ্য চালানটি কাস্টমস আটক করেছে ২৬ জানুয়ারি। আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মামলা করেছে ২৯ জানুয়ারি। আগে কেন মামলা করেননি সে বিষয়েও কোনো জবাব দিতে পারেননি। মিথ্যা ঘোষণার পরও আমদানিকারকের বিরুদ্ধে মামলা করেননি কেন সে বিষয়েও কোনো জবাব দিতে পারেননি।
মামলায় মো. আবুল কালাম আজাদ, মো. শহিদুল আলম, মো. ইব্রাহিম প্রধানিয়া অপু, মো. আজিজকে আসামি করা হয়। আমদানিকারককে আসামি না করে কেন এদের আসামি করা হয়েছেÑসে বিষয়ে খায়ের বলেন, এদের বিরুদ্ধে এর আগে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযোগটি নিষ্পত্তির অনুরোধ করেন খায়ের।
সূত্র জানায়, সিঅ্যান্ডএফের লাইসেন্সের সাময়িক স্থগিতাদেশ, নোটিসের জবাব, উচ্চ আদালদের নির্দেশনা, শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর বক্তব্য ও সিঅ্যান্ডএফের দলিলাদি পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের বিরুদ্ধে মামলা না করে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এছাড়া সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট তার এআইএনের বিপরীতে প্রাপ্ত পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি নোটিংয়ের বিষয়টি অবহিত হয়ে কাস্টম হাউসকে আগেই জানাতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। এতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের সঙ্গে যোগসাজশের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। যোগসাজশে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য খালাসের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি প্রদানসহ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন।
সিঅ্যান্ডএফ কাস্টমস এজেন্টস (লাইসেন্সিং) বিধিমালা-২০১৬ লঙ্ঘন করায় খায়ের ব্রাদার্সের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে এজেন্টকে এক কোটি টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জরিমানার টাকা ৩০ দিনের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।