শেখ আবু তালেব: দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) আকারের উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনা মহামারিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু এ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল বিতরণ করেছে মাত্র ৫০ কোটি টাকা। অথচ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় তিন হাজার কোটি টাকার।
গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এ পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের অগ্রগতি জানতে সম্প্রতি বৈঠক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সব ব্যাংক মিলিয়ে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এ খাতে চার হাজার ২৮০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। জানা গেছে, সরকার সিএমএসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তহবিলও গঠন করেছে।
তহবিল গঠনের পর ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঋণ বিতরণ শেষ করতে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছ বাংলাদেশ ব্যাংক। মোট ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংককে দুই হাজার ৯৭৩ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের এক হাজার ৩৭ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ৫৩৭ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ২৬৩ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৮৪৬ কোটি ও বেসিক ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৭০ কোটি টাকা।
যদিও গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মাত্র ৫০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করতে পেরেছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার এক দশমিক ৬৮ শতাংশ। জানা গেছে, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের করুণ চিত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীলরা। ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে গতি আনতেই বৈঠক ডেকেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে বিস্তৃত শাখা। ইচ্ছা করলেই এ ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে তেমন উদ্যোগ নিচ্ছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছুটির দিনেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করা হচ্ছে। ঋণ বিতরণে তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। সারা দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় তফসিলি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর সর্বাধিক শাখা রয়েছে। গ্রাম পর্যন্ত শাখা বিস্তৃত রয়েছে।
জানা গেছে, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মাঝে বিতরণ করা ঋণের আকার ছোট। ফাইল মঞ্জুরসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া অন্যান্য ঋণ মঞ্জুরের মতোই। এতে বেশি কাজ করতে হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়ার তেমন নজির নেই। বেসরকারি ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করে ঋণ দিতে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা সেভাবে করেন না। এছাড়া ঋণ পেতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সময় বেশি নেয় বলে অভিযোগ করে আসছেন উদ্যোক্তারা।
অবশ্য ব্যাংকাররা বলছেন, ছোট উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে তেমন প্রচার প্রচারণা নেই। এজন্য অনেক উদ্যোক্তা বিষয়টি জানেনই না। এতে আবেদনও কম পড়েছে। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের এক হাজার ২২৫টি, অগ্রণী ব্যাংকের ৯৫৮টি, জনতা ব্যাংকের ৯১৫টি, রূপালী ব্যাংকের ৫৭৬টি ও একসময়কার বিশেষায়িত থাকা বেসিক ব্যাংকের ৭২টি শাখা রয়েছে।
জানা গেছে, ঋণ বিতরণে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত লক্ষ্যামাত্রা নির্ধারণ করা হয় প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি ও ইসলামি ধারার জন্য পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য ১৭০ ও বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলোকে ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) ১৩৭ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) নির্ধারণ করা হয় ৩৬ কোটি টাকা।
জাতীয় অর্থনীতিতে করোনা মহামরির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে প্রধানমন্ত্রী এক লাখ কোটি টাকার ওপরে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে রয়েছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) জন্য স্বল্প সুদে ২০ হাজার কোটি টাকা।
এ ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৯ শতাংশ। এর মধ্যে সাড়ে চার শতাংশ সরকার দেবে, বাকি সাড়ে চার শতাংশ দেবেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু ব্যাংকগুলো তারপরও ঋণ বিতরণে অনাগ্রহ দেখায়। এতে একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট রিস্ক গ্যারান্টি স্কিম ঘোষণা করে।