রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাহাড়ি প্রাকৃতিক বন

খন্দকার এম কায়েদুজ্জামান: সময় রাত ৩টা ৪৫ মিনিট। শায়েস্তাগঞ্জের খোয়াই চত্বর। শেষরাতের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর জুয়েল ভাই। দুই একটা অটোবাইক চালকহীন পড়ে আছে রাস্তার পাশে। কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষার পর সিএনজি ড্রাইভার এলেন চুনারুঘাট থেকে। সিএনজি আগেই ঠিক করা ছিল। আমাদের গন্তব্য রেমা-কালেঙ্গা বন বিট।

ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা। কুয়াশার মধ্যে একহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শ্লথগতিতে ছুটে চলছে আমাদের সিএনজি। গা ছমছমে এক ঘণ্টা যাত্রার পর পৌঁছে গেলাম রেমা-কালেঙ্গা বনভূমির প্রবেশমুখে।

গাইড রুহুল আমিন চাচাকে নিয়ে আমরা বনের মধ্যে ঠিক ভোর ৬টায় ঢুকে পড়ি। কুয়াশাভেজা মেঠোপথ চলে গেছে বনের মধ্য দিয়ে। দুপাশে সারি সারি কাঠগাছ আর লতানো ঝোপঝাড়। হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লেকের পাড়ে চলে আসি। এখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা ওয়াচ টাওয়ার। আমরা টাওয়ারে উঠি। চারপাশে তাকাতেই মনটা জুড়িয়ে গেল। সুয্যিমামা তখন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বনের কপাল ছুঁয়ে।

একপাশে গভীর বন। অন্যপাশে দিগন্তজোড়া মাঠ। সেই মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক বনমোরগ। বনমোরগ দেখতে আমরা মাঠে চলে আসি। ওপরে তাকাতেই দেখি মুখপোড়া হনুমানের দল। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঠে নামছে, আবার গাছে চড়ছে।

হনুমানের কলহকে পাশ কাটিয়ে আমরা মাঠের মধ্য দিয়ে এগোতে থাকি। মাঠ পেরিয়ে গভীর বনে ঢুকে পড়ি। এদিকে উঁচুনিচু টিলা রয়েছে। টিলার মাঝখান দিয়ে বনের রাস্তা চলে গেছে অনেক দূর। বাহারি লালচে পাতায় সয়লাব পুরো রাস্তা। বনের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে সকালের রোদ। শত ফুট উঁচু গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে বনের রেখা ছাড়িয়ে। গাছগুলোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টায় লিপ্ত কিছু পরাশ্রয়ী স্বর্ণলতা। গাইড চাচা আমাদের বিরল প্রজাতির একটা বিশাল বড় কাঠবিড়ালি দেখালেন। মালয়ান নামের এ কাঠবিড়ালি শুধু এ বনেই পাওয়া যায়। এখানে মোট পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালির দেখা মেলে।

রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের অন্যতম বড় পাহাড়ি প্রাকৃতিক বন। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত এ বনের আয়তন প্রায় ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। রেমা, কালেঙ্গা, ছনবাড়ি ও রশিদপুর- এ চারটি বিটে বিভক্ত রেমা-কালেঙ্গা বনভূমি। এ বনে কয়েক প্রকার বিরল প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। নানা পাখিরও আবাসস্থলও এটি। যেমন ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, চিল প্রভৃতি। উল্টোলেজি বানর, রেসাস ও নিশাচর লজ্জাবতী বানর নামের তিন প্রজাতির বানর আছে এখানে। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, দেশি বন শূকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এ বনে কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াশ, লাউডগাসহ রয়েছে আঠার জাতের সাপ। কথিত আছে, ষাটের দশকে এখানে চিতাবাঘ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণ ছিল।

রেমা-কালেঙ্গা বনের জীববৈচিত্র্য অবলোকন করতে করতে আমরা বনের শেষ প্রান্তে চলে যাই। পথে একটি পাহাড়ি ছড়া পার করি। বনের শেষ মাথায় রয়েছে রেমা পোস্ট অফিস। ১৯৭১ সালে এখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। দুজন শহীদের কবর বাঁধাই করে রাখা আছে পোস্ট অফিসের পাশে। পোস্ট অফিসের পর শুরু হয়েছে রেমা চা বাগান। আমরা চা বাগান পেরিয়ে চলে যাই রাবার বাগানে। রাবার বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খোয়াই নদী। নৌকায় চড়ে নদী পার হয়ে আমরা পৌঁছে যাই জারুলিয়া। সেখান থেকে অটোবাইকে চড়ে আবারও চুনারুঘাট।

চুনারুঘাটে দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। প্রায় ৮ ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার হাইকিং করতে হয় আমাদের। শরীর অবসাদগ্রস্ত। কিন্তু তবু মুখে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। একটু ফুরসত পেলে আবার বেড়াতে যাবো কালেঙ্গার বনে। রহস্যময় বনের গভীরে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা হাতছাড়া করতে চাই না।

প্রভাষক, সিএসই ডিপার্টমেন্ট

দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০