পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী বলা হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। একটি রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী হলো এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যারা মিয়ানমারের পশ্চিমে রাখাইন রাজ্যে বাস করত। ২০১৬-১৭ সালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের আগে আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাস করত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; কিন্তু হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ ও নাস্তিক বিদ্যমান। ১৯৮২ সালে বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা একটি সম্মিলিত জনগোষ্ঠী, যেখানে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ব্রুনাইয়ের জনসংখ্যা আছে। অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া গেলেও মিয়ানমার সরকার তাদের অস্বীকার করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ, শিক্ষা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা গ্রহণ করা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট ওয়াচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে ‘জাতিগত নির্মূলতা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মিয়ানমারের বিশেষ তদন্তকারী ইয়ং হি লি বিশ্বাস করেন, মিয়ানমার পুরোপুরি তাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়াতে চায়। বাস্তবে সেটাই করে দেখিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখনও সরকারের অধিকাংশ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে ২৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ রয়েছে এবং তাদের মধ্য থেকে একজন উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। ফলে বোঝা যায়, এই সরকার অনেকটা সামরিক কায়দায় পরিচালিত হয়। রোহিঙ্গাদের দাবি ছিল তারা মিয়ানমারের পশ্চিমে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছেন। এমনকি ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত বার্মা সাম্রাজ্য গ্রন্থে ব্রিটিশ মনীষী বুকানন হ্যামিল্টন বলেছিলেন, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসারীরা অনেক দিন ধরে আরাকানে বাস করছে। “
১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮ হাজার ২৫৫ মুসলিম ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এক লাখ ৭৮ হাজার ৬৪৭ জন হয়। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বাংলার সস্তাশ্রম, যা আরাকানের কৃষিকাজে লাগত। ঐতিহাসিক থান্ট মিন্ট ইউ বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বার্মায় আসা ভারতীয়দের সংখ্যা কোনোভাবেই আড়াই লাখের কম নয়। এভাবে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে চার লাখ ৮০ হাজার হয় এবং মিয়ানমারের রেঙ্গুন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিবাসনকেন্দ্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রেকর্ড ভেঙে ফেলে। মিয়ানমারের রেঙ্গুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাথিন ও মৌমেইনের মতো অধিকাংশ বড় শহরে ভারতীয় অভিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ শাসনে বার্মিজরা অসহায়ত্ব বোধ করত এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে তারা অভিবাসীদের ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত। অভিবাসনের ফলে মূল সংঘাত আরাকানেই সবচেয়ে বেশি প্রকট ছিল। ধর্মীয় কারণে রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভেতরে একটি দ্বন্দ্ব^ বিরাজমান ছিল। ১৯৩৯ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার ও তিন তুতের দ্বারা একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে পালায়। তারপর মিয়ানমারে চলে আসে জাপানি দখলদারিত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা ব্রিটিশদের পরাজিত করে মিয়ানমার দখল করে। জাপানিদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থি অস্ত্রধারী মুসলিমদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তখন জাপানিদের বিরোধিতা করে। বিরোধিতার কারণে জাপানিরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতন করেছিল। সেই সময় প্রায় ৬২ হাজার রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। নিগৃহীত এই জনগোষ্ঠী অতীতকাল থেকে নির্যাতিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমর্থন করায় মিয়ানমারের কাছ থেকে তারা বেইমান জনগোষ্ঠী উপাধি পায়। রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের জনবল নিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি করে আরাকান স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে রোহিঙ্গাদের ওপর দায়িত্ব বেড়ে যায়। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে দুবার তাদের ওপর সামরিক অভিযান চালানো হলে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরবাদ বৌদ্ধধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। এর মাধ্যমেই তারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যেমনÑরোহিঙ্গা, কোকাং, পানথাই, বোরাং, চংমিং, চীনা হুই মুসলিমদের মতো জাতিসত্তাগুলোকে ব্যাপকভাবে নির্যাতন করে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভেতরে দাঙ্গার উসকানি দেয় এবং এই কাজে তারা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়। জাতিগত কোন্দলকে কেন্দ্র করে রাখাইনে ২০১২ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে কয়েক দফায় সংঘাত হয়।
অধিকাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সুন্নি মুসলিম এবং তারা সুফিবাদে বিশ্বাস করে। মিয়ানমার সরকার তাদের শিক্ষা গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করলে তারা মসজিদে ধর্মীয় শিক্ষাকে ঐতিহ্যগতভাবে প্রাধান্য দেয়। প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। ২০১৬ সালে মেডিকেল সাময়িকী ল্যান্সেটের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিশুরা কম ওজন নিয়ে জš§গ্রহণ করে, অপুষ্টি ও ডায়রিয়া রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করে। প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতে অধিকাংশ রোহিঙ্গার প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ২২৪ শিশু জšে§র সময় মৃত্যুবরণ করে, যা মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় চারজন বেশি। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সরকার দ্বারা পরিচালিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের শিবিরে ৪০ শতাংশ শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত, যা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু এবং বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনপদ বলা হয় এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব হারায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। পরবর্তীকালে মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারের ফলে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে চলে আসে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পাঠানোর চেষ্টা করে। ২০০৪ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের অধিকাংশের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাদের ওপর বিভিন্নভাবে অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের জমি জবরদখল করা, জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা এবং বিয়ের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৫ সালে। ২০০৯ সালে মিয়ানমারের কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকের পরে ৯ হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১১ সালের ১৬ অক্টোবর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করে। ২০১২ সালে আবার রাখাইনে দাঙ্গার শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ মিয়ানমার সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি নিষিদ্ধ করে এবং তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে সংখ্যালঘুদের বাঙালি হিসেবে নিবন্ধনের আহ্বান করে। ২০১৪ সালের ৭ মে, যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ একটি বিল পাস করে সেখানে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানায়। লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্টেট ক্রাইম ইনিশিয়েটিভ কমিটির গবেষকরা বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করে দেশ থেকে বিতাড়িত করার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা হচ্ছে বলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের দুই বছর পূর্ণ হলো। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের এই দিনে গণহত্যা শুরু করলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট তাদের মিয়ানমারে পাঠানোর প্রস্তাব দিলে তারা সাড়া দেয়নি। এদিন সংবাদমাধ্যমকে রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপেট্রিয়েশন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা বেলা সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু কোনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্যে আসেননি। যারা স্বেচ্ছায়
মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হবে, শুধু তাদেরই ফেরত পাঠানো হবে। জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না।” অন্যদিকে রোহিঙ্গা নেতা মহীবুল্লাহ আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমদের একত্র করে মহাসমাবেশের আয়োজন করেছিল, যেটি বাংলাদেশের জন্য একটি অশনিসংকেত। একমাত্র আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট সমাধান করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়