নিজস্ব প্রতিবেদক : ১১ দফা দাবিতে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য পণ্য পরিবহন বন্ধ রেখেছেন নৌযান শ্রমিকরা। এ ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের বহির্নোঙ্গর এবং বিভিন্ন ঘাটে অবস্থানরত জাহাজ থেকেও পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।
মালিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে সমাধান না আসায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার মধ্যরাত থেকে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম জানান।
গতকাল সকালে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০ পণ্যবাহী নৌযান এ ধর্মঘটের আওতায় রয়েছে। ‘মালিকদের পক্ষ থেকে এখনও কোনো ধরনের আশ্বাস আমরা পাইনি। প্রায় দুই লাখ শ্রমিক আমাদের এ ধর্মঘটে রয়েছেন। সকাল থেকে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগানে স্লোগানে তারা কর্মসূচি পালন করছেন।’
গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম অধিদপ্তরের সামনে নৌশ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন থেকে ১১ দাবিতে এ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। তাদের দাবিগুলো হলোÑ১. বাল্কহেডসহ সব নৌযান ও নৌপথে চাঁদাবাজি-ডাকাতি বন্ধ করা। ২. ২০১৬ সালে ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী নৌযানের সর্বস্তরের শ্রমিকদের বেতন প্রদান। ৩. ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস এবং মালিক কর্তৃক খাদ্যভাতা প্রদান। ৪. সব নৌযান শ্রমিকের সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ। ৫. এনডোর্স, ইনচার্জ, টেকনিক্যাল ভাতা পুনর্নির্ধারণ। ৬. কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ। ৭. প্রত্যেক নৌশ্রমিককে মালিক কর্তৃক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বুক প্রদান। ৮. নদীর নাব্য রক্ষা ও প্রয়োজনীয় মার্কা, বয়া ও বাতি স্থাপন। ৯. মাস্টার-চালক পরীক্ষা, সনদ বিতরণ ও নবায়ন, বেআইনি নৌচলাচল বন্ধ করা। ১০. নৌপরিবহন অধিদপ্তরে সব ধরনের অনিয়ম ও শ্রমিক হয়রানি বন্ধ এবং ১১. নৌযান শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এসব দাবির বিষয়ে আলোচনার জন্য সোমবার আন্দোলনরত শ্রমিক প্রতিনিধিদের বৈঠকে ডেকেছিলেন মালিকরা। সোমবার বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত
ঢাকার মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে ওই বৈঠকে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিআইডব্লিটিএ’র চেয়ারম্যান, শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক, নৌ-পুলিশের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।
বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা। শাহ আলম বলেন, ‘আমরা মালিকদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলোচনায় আমাদের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরেছি। কিন্তু মালিকরা আমাদের কোনো দাবি মেনে না নেওয়ায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে হয়েছে।’
একই ধরনের দাবিতে গত বছরের নভেম্বরেও আন্দোলন করেছিল শ্রমিকরা। আশ্বাস পেয়ে তখন আন্দোলন থামালেও দাবি আর পূরণ হয়নি বলে শ্রমিকরা জানান।
পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর এবং বিভিন্ন ঘাটে অবস্থানরত জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। তবে বন্দরের জেটিতে কন্টেইনার জাহাজে পণ্য ওঠানামা অব্যাহত আছে।
সাধারণত বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য নিয়ে কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঘাটে তা খালাস করে লাইটারেজ জাহাজ। ধর্মঘটে তা বন্ধ রেখেছেন শ্রমিকরা।
নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম বলেন, ‘রাত ১২টা থেকে সব লাইটার চলচাল বন্ধ রাখা হয়েছে। যতক্ষণ ১১ দফা দাবি মানা না হবে, ততক্ষণ ধর্মঘট চলবে। দুই বছর ধরে আমাদের এ আন্দোলন চলছে।’
চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় এক হাজার ৬০০ লাইটার জাহাজ চলাচল করে জানিয়ে নবী আলম বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাদের প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক এবং সারাদেশে মোট দুই লাখ শ্রমিক আছে এ ধর্মঘটে।
লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ বলেন, ধর্মঘটের কারণে বহির্নোঙ্গরে কাজ বন্ধ আছে। আর চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজগুলো অপেক্ষমাণ আছে। সেগুলোর কোনোটিতেই লাইটার যায়নি। তাই পণ্য খালাসের কাজ বন্ধ আছে।’
যদিও কয়টি জাহাজ বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমাণ তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি বন্দর সচিব। তিনি বলেন, ‘ধর্মঘটের কোনো প্রভাব কন্টেইনার জেটিগুলোতে পড়েনি। সেখানে কন্টেইনারবাহী জাহাজ থেকে কন্টেইনার ওঠানামার কাজ চলছে।’
এদিকে নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরেও পণ্যবাহী জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রয়েছে। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের মোংলা উপজেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান বাবুল বলেন, এ বন্দরে ‘সহস্রাধিক’ পণ্যবাহী নৌযানে ১৪ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।
‘তারা সবাই কাজ বন্ধ রেখেছেন। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।’
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার মো. ফকর উদ্দিন বলেন, সার, কয়লা, পাথরবাহী মোট ১৫টি দেশি-বিদেশি জাহাজ বর্তমানে মোংলা বন্দরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে পাঁচটি জাহাজের পণ্য ওঠানামার কাজ শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার সেগুলো বন্দর ত্যাগ করবে। নতুন করে আজ আরও তিনটি জাহাজ আজ বন্দরে ভেড়ার কথা। নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট শুরু হওয়ায় এখন পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রয়েছে। ধর্মঘট দীর্ঘায়িত হলে বন্দরে জাহাজ জট বাড়বে, আমদানি-রপ্তানিকারকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
