নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রসারণমূলক বাজেট প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে স্বাধীন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। কিন্তু সে বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জনে যে পূর্বশর্তগুলো মান্য করা দরকার ছিল, তা করা হচ্ছে না বলে মনে করে সংস্থাটি। ফলে বড় বাজেট ঘোষণা করা হলেও তার বাস্তবায়ন চিত্র নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে সিপিডি। সংস্থাটি মনে করে, বাজেটের গুণগত বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরে এসব কথা জানায় সিপিডি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় মিডিয়া ব্রিফে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান। বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এবং গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মেয়াজ্জেম।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরের পরে সরকার যে সংস্কারের কথা বলেছিলো, সেটা হারিয়ে গেছে। একটি নির্বাচনের পর ২০১৫ সালে আমাদের ধারণা ছিল যে, সরকার একটু স্থিতাবস্থায় এলে পূর্বঘোষিত সংস্কারের উদ্যোগুলো নেবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ সংস্কারহীনতা বাজেট বাস্তবায়নের গুণমান উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে যেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি তেমনি এগুলো পর্যবেক্ষণে সংসদের যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, সেগুলোও খুব দুর্বলভাবে হয়েছে। ফলে অনিয়ম করে পার পেয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে একটি কমিশন গঠনের কথা আমরা বলে আসছি। এটি কোনো কারিগরি বিষয় নয়। এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। আগামী বাজেট নির্বাচনের আগের বছরের বাজেট। ফলে এ অর্থবছরে সরকার সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে আমাদের মনে হয় না। কারণ ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির স্বার্থ যুক্ত। দেবপ্রিয় বলেন, আমরা সম্প্রসারণমূলক বাজেটের পক্ষে। কিন্তু সেই বাজেট বাস্তবায়নে যে পূর্বশর্তগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার ছিল, সেগুলো করা হয়নি। আর এক বছরে সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে আমাদের মনে হয় না।
তবে বাজেটের গুণগত বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর উন্নতির জন্য সম্প্রসারণমূলক বাজেট প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছে সিপিডি। এ বিষয়ে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী অর্থবছরে চার লাখ দুই হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এটা যদি হয় তাহলে মাথাপিছু খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ হাজার টাকা। ডলারের হিসাবে মাত্র ৩০০ ডলারের মতো। বাংলাদেশের সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায়ও এ খরচ অনেক কম। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে আমাদের বাজেট জিডিপির প্রায় ১৭ শতাংশের মতো। এ ব্যয় আরও বাড়ানো উচিত। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে বড় বাজেটের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এরকম পর্যায়ে অন্যান্য দেশগুলো ছিল, যারা দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। যেমন মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে এরকম সময়ে বাজেটের আকার ছিল জিডিপির ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।
মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম খান অনুষ্ঠানে বলেন, বর্তমানে সরকার বেশকিছু বিষয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এর মধ্যে অন্যতম সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে গত কয়েক মাসে খাদ্যেমূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে খাদ্য মজুতের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।
নতুন ভ্যাট আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়ন করা হলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে, যা চূড়ান্তভাবে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। তাই সবপর্যায়ে একসঙ্গে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর করা ঠিক হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে ভ্যাটহার নির্ধারণের প্রস্তাব দেন তিনি।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন গত কয়েক বছরের তুলনায় ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে গুণগত মানের বিষয়ে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের বাস্তবায়ন জোরদারে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নজরদারি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর প্রকল্পে বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থের ব্যয় কমে যাচ্ছে। এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত বলে উল্লেখ করে সিপিডি। কারণ কম সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি। যা সরকারের বোঝা বাড়াচ্ছে। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় হওয়া উচিত বলে মনে করে সিপিডি।
আসছে বাজেট নিয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমানোসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে সিপিডি। তৌফিকুল ইসলাম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এটির দাম বিশ্ববাজারে কম থাকলেও আমাদের এখানে কমছে না। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই আমরা বলছি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি কমিশন গঠন করতে। প্রতিবছর সরকার জনগণের করের টাকায় যেভাবে ব্যাংকগুলোকে নিঃশর্তভাবে পুনঃমূলধনি করা হচ্ছে, এ বিষয়টি অবশ্যই থামাতে হবে। আগামী বাজেটে যদি এ ধরনের কোনো বরাদ্দ থাকে তাহলে সেটার সঙ্গে অবশ্যই পারফরম্যান্সের শর্ত যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।
Add Comment