জয়নাল আবেদিন: ঋণখেলাপি ব্যাংক খাতের জন্য একটি বিষফোঁড়ার নাম। অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের মতোই শীর্ষ খেলাপিদের কাছে আটকে আছে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। বহুদিন থেকে খেলাপি হয়ে পড়া এসব ঋণের নেই কোনো আদায় অগ্রগতি। সে কারণেই বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনে আসছে বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ খেলাপিদের কাছেই আটকে আছে ব্যাংক দুটির প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু কোনোভাবেই ব্যাংকগুলো সেই টাকা আদায় করতে পারছে না।
বিশেষ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনভিত্তিক হিসাব শেষে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৯৪১ কোটি টাকা, যার পুরোটাই এখন মন্দ মানে খেলাপি। ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় খেলাপির নাম মেসার্স ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং লিমিটেড। ২০১১ সালে বিতরণ করা ঋণটি এখন শীর্ষ খেলাপির তালিকায় সবার ওপরে। ২৮৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ঋণ এখন সুদে-আসলে ৩১৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, ঋণটি আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে (কৃষিঋণ বিতরণ) অনুমোদিত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে শিল্প খাতে বৃহৎ ঋণ দেওয়াটা অযৌক্তিক। বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
বিকেবিতে খেলাপির তালিকায় ১০১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা মন্দ মানের খেলাপি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মেসার্স আনিকা এন্টারপ্রাইজ। এছাড়া ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় রয়েছে মেসার্স এসএ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, মেসার্স ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স রহমান ট্রেডিং, মেসার্স আব্বাস ট্রেডিং, আরএন সোয়েটার, এনএ করপোরেশন, মা ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লাইয়ার্স লিমিটেড, মেসার্স হিমালয় আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড, রোজবার্গ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মেসার্স ফেয়ার ইয়ার্ন টুইস্টিং লিমিটেড, মেসার্স কেয়া ইয়ার্ন মিলস লিমিটেড, মিমটেক্স নিটিং গার্মেন্টস, অটো ডিফাইন, মেসার্স এ্যাকোয়া রিসোর্সেস লিমিটেড, মেসার্স ব্রাদার্স অ্যাসোসিয়েট, উদালিয়া চা বাগান, ফিয়াজ ট্রেডিং ও এসমা পোলট্রি ফার্ম অ্যান্ড ফিডস লিমিটেড। মোট ২০ খেলাপির কাছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৯৪০ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ মোট ২২ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে দুই হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণের ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট বিতরণ ছিল পাঁচ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে এক হাজার ৭১৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণের প্রায় ৩১ শতাংশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকদের জন্য গঠিত বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক রাকাবের শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান হলো রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার শাহ ইসমাইল গাজী কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড। চলতি বছরের জুন শেষে এ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০১১ সালে শাহ ইসমাইল গাজী কোল্ড স্টোরেজকে ঋণ দিয়েছিল রাকাব। কিন্তু সে ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪১ কোটি ২৯ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আশরাফ সিডস স্টোর লিমিটেডের। রাজশাহীর দুর্গাপুরের প্রতিষ্ঠান নিগার কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের কাছে ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ আছে ব্যাংকটির। বগুড়ার শেরপুরের প্রতিষ্ঠান এগ্রো আর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছে রাকাবের খেলাপি ঋণ আছে ২২ কোটি টাকা। এছাড়া রংপুরের শাহ আমানত কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের কাছে প্রায় ২২ কোটি টাকা এবং দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের কাছে ২০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির। বগুড়ার আল ফারুক ব্যাগস লিমিটেডের কাছে প্রায় ১৭ কোটি, রাজশাহীর প্রশিকা উন্নয়ন কেন্দ্রের কাছে প্রায় ১৫ কোটি, বগুড়ার টিএসএ অটো ব্রিকসের কাছে সাড়ে ১৪ কোটি এবং একনিজ ফিড মিলসের কাছে ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। শীর্ষ ১০ খেলাপির হাতে আটকে আছে বিশেষায়িত এই ব্যাংকটির ২৩৮ কোটি চার লাখ টাকা।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জুনভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৩৮৩টি শাখার মধ্যে ১৯৫ শাখাই লোকসানে রয়েছে। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের (২০১৯-২০) রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরিচালন লোকসানের পরিমাণ ৬০২ কোটি টাকা। এদিকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মোট এক হাজার ৩৮টি শাখার মধ্যে লোকসানে রয়েছে ৩৭১টি। আর ব্যাংকগুলোর লোকসান সামাল দিতে বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া শেয়ার বিজকে জানান, ঋণগুলো অনেক পুরোনো। খেলাপিও হয়েছে অনেক আগে। তবে খেলাপি সব গ্রাহকের সঙ্গে ঋণগুলো আদায়ের জন্য আমরা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যে যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় আদায়ের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি যারা যোগাযোগে সাড়া দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টের আওতায় ঋণ পুনঃতফসিল করছেন।