রহমত রহমান: দেশের পোশাকশিল্পের শীর্ষ রপ্তানিকারকদের মধ্যে অন্যতম ডিবিএল গ্রুপ (দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড)। স্বনামধন্য এ গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিবিএল সিরামিকস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে প্রকৃত উৎপাদন গোপন করে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করে মামলা করেছে। সম্প্রতি এ মামলা করা হয়। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, গাজীপুর শ্রীপুর ধনুয়া এলাকায় অবস্থিত ডিবিএল সিরামিকস লিমিটেড। ২০১৭ সালে উৎপাদনে আসা প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃত উৎপাদন অপেক্ষা কম উৎপাদন দেখিয়ে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরে এনবিআরের নির্দেশে ভ্যাট গোয়েন্দা তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বছরের ৪ মার্চ ভ্যাট গোয়েন্দার গঠিত টিম গাজীপুরে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা ও গুলশানে করপোরেট অফিসে (বাড়ি-৩৪, রোড-৩, গুলশান-১) অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন ভ্যাট গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ছালাউদ্দিন রিপন, খন্দকার মশিউর রহমান, মো. মাহিদুল ইসলাম ও মুহাম্মদ মহিউদ্দিন।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দেওয়া ভ্যাট ও বাণিজ্যিক দলিলাদি পরীক্ষা করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি করে বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে কারখানায় মজুত কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের হিসাব নেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির উপস্থাপিত দলিলাদি, সরেজমিনে প্রাপ্ত মজুত পণ্যের সঙ্গে বিক্রয় হিসাব দলিলের ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। একই দিন প্রতিষ্ঠানের করপোরেট অফিসে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিক্রয় চালান জব্দ করা হয়। কর্মকর্তারা দেখতে পান, প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দিতে একই ক্রমিক নম্বরের একাধিক বিক্রয় চালান ব্যবহার করেছে। পরে আড়াআড়ি যাচাই করে ফাঁকি উদ্ঘাটন করে মামলা করা হয়।

মামলার প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের ১০ জুলাই থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৫০টি প্যারালাল চালানের মাধ্যমে বিভিন্ন সাইজের ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৬২১ বর্গফুট টাইলস সরবরাহ করেছে, যাতে রাজস্ব দেওয়া হয়নি। ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৬২১ বর্গফুট টাইলসের সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্য ১৪ কোটি তিন লাখ ২২ হাজার ৮২৯ টাকা, যার বিপরীতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক দুই কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৪২৪ টাকা এবং ভ্যাট দুই কোটি ৪১ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৫ টাকা। মোট রাজস্ব ফাঁকি (সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট) চার কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার ৭৫০ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কারখানা পরিদর্শনে কারখানায় মজুত হিসাবের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় রেজিস্টার আড়াআড়িভাবে যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় রেজিস্টারের তুলনায় সরেজমিনে উৎপাদিত পণ্যের মজুত কম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এসব পণ্য বাজারে সরবরাহ করেছে। উৎপাদিত পণ্য বাণিজ্যিক চালান ও অবৈধ সমান্তরাল ভ্যাট চালানের মাধ্যমে ভ্যাট পরিহার করে সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি লাভবান হয়েছে।
আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানে ৬৭ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৮ দশমিক ৬৩৫ বর্গফুট বিভিন্ন সাইজের ফ্লোর এবং ওয়াল টাইলস মজুত পাওয়া যায়। অথচ বিক্রয় হিসাব রেজিস্টারে উৎপাদিত সমাপনী মজুত দেখানো হয়েছে এক কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৬ দশমিক ৪৮ বর্গফুট। অর্থাৎ সরেজমিন পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় হিসাব অপেক্ষা ৪৬ লাখ ৫০ হাজার ৮৯৭ দশমিক ৮৪ বর্গফুট কম পাওয়া যায়, যা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বাজারে সরবরাহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এর কোনো জবাব বা হিসাব দিতে পারেনি। ৪৬ লাখ ৫০ হাজার ৮৯৭ দশমিক ৮৪ বর্গফুট টাইলসের সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্য ২১ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার ১৪২ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক তিন কোটি ২০ লাখ ৩৫ হাজার ৫২১ টাকা ও ভ্যাট তিন কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ৮৪৯ টাকা।
মোট রাজস্ব ফাঁকি (সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট) ছয় কোটি ৮৮ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ টাকা। ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব দুই শতাংশ হারে সুদ হিসাব করলে ফাঁকির পরিমাণ বেড়ে যাবে। অপরদিকে দ্বৈত কর পরিহারের লক্ষ্যে ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৬২১ বর্গফুট টাইলস প্রযোজ্য রাজস্ব চার কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার ৭৫০ টাকা হিসাব করা হয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখবে ভ্যাট কমিশনারেট।
এনবিআর সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায় ও ন্যায় নির্ণয়ের জন্য মামলা ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেটে পাঠিয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় নিয়ে নজরদারি বাড়ানো, মাঝে মাঝে ঝটিকা অভিযান এবং নিয়মিত দাখিলপত্র যাচাই করতে অনুরোধ করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির আরও রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে কমিশনারেটকে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আরও রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে প্রতিষ্ঠানটিকে নিরীক্ষার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা।
ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে বক্তব্য জানতে কয়েক দিন ধরে ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ জব্বারের ব্যক্তিগত মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। ২৮ অক্টোবর তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি এটি দেখি না। আমার আরেক ভাই দেখেন। তার সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাব।’ এরপর কয়েক দিন তার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন ও খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি। ২ অক্টোবর ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার নলেজে নেই। আমি জেনে জানাচ্ছি বলে ফোন কেটে দেন।’ পরে বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়নি। তবে গ্রুপের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও বিষয়টি জানাবেন বলে নিশ্চিত করেন। পরে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে ঢাকার ১০২ গ্রিন রোডে ছোট কারখানা দিয়ে শুরু হয় ডিবিএল গ্রুপ। পোশাক দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে সিরামিক টাইলস, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, ড্রেজিং, ওষুধসহ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৪টি। গাজীপুরের মাওনায় ৩০ একর জমির ওপর ডিবিএল সিরামিক কারখানা। উৎপাদন শুরু হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে। কারখানাটির উৎপাদন সক্ষমতা দিনে ৪৫ হাজার বর্গমিটার টাইলস।