এম নোমান শরীফ: টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার তথাকথিত খলনায়ক ‘ওসামা বিন লাদেন’ একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত, নন্দিত ও নিন্দিত প্রভাবশালী একটি নাম। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই নামকে কেন্দ্র করে কিছু স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সীমারেখায় খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নতুন রেখা অঙ্কিত হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ব রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যক্তিস্বাধীনতা-বিরোধী ও মানবাধিকার পরিপন্থি বিভিন্ন ধরনের আইনকানুন ও নিয়মনীতির উম্মেষ ঘটে। ‘তথ্যসন্ত্রাস’ শৈল্পিক রূপ ধারণ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আকাশে ধ্রুবতারার মতো বিচরণ করে। ঐতিহাসিক ১১ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ওসামা বিন লাদেনের দায় কতটুকু তা যুক্তরাষ্ট্র সরকার গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেও আফগানিস্তান ও ইরাককে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গোরস্তানে পরিণত করে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ৪৬ মিনিট থেকে ১০টা ৬ মিনিটের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (টুইন টাওয়ার) ও পেন্টাগনে হামলা হয়। তথাকথিত সন্ত্রাসীদের নামের তালিকা বারকয়েক সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়। হামলার ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন এবং ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এই হামলার জন্য আল-কায়দাসমর্থিত মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসীদের দায়ী করে। মূল অপরাধী ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে ওসামা বিন লাদেনকে অভিযুক্ত করে। সেদিন মিডিয়ার জš§ সার্থকতা লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার সঙ্গে তাবৎ পশ্চিমা মিডিয়া বিন লাদেন ও আল-কায়দার সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধেও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায়। এসব প্রচারণার ফলে মুসলিম সংখালঘু দেশগুলোয় মুসলমানদের জীবন-জীবিকা অত্যন্ত সংকীর্ণ ও মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে। হামলার মাত্র ছয় দিন পর কোনো তদন্ত, গ্রহণযোগ্য তথ্য-প্রমাণ ও মতামত ছাড়াই প্রেসিডেন্ট বুশ পেন্টাগন কর্তৃক প্রস্তুতকৃত আফগান ও ইরাক যুদ্ধের রোডম্যাপ-সংবলিত ‘টপ সিক্রেট’ ফাইলে স্বাক্ষর করেন। দুই দিন পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রামস্ফেল্ডের উপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিফেন্স পলিসি বোর্ড’-এর আরেকটা ফাইলে স্বাক্ষর করেন। উল্লেখ্য, ডিফেন্স পলিসি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইহুদি বুদ্ধিজীবী রিচার্ড পার্ল ১৯৯৬ সালের ‘রিবিল্ডিং জাইনিজম’ বা ইহুদিবাদের পুনর্জšে§র অন্যতম প্রবক্তা। তিনি ইরাক ও আফগান যুদ্ধের অনুঘটকদের একজন বলে পরিচিত। ওই দুই বৈঠক ও ফাইলগুলোয় মধ্য এশিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে গ্যাসের ওপর একচ্ছত্র যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠা করার জন্য পথের কাঁটা তালেবান নেতৃত্বাধীন, আল-কায়দার সহযোগী আফগান সরকারকে ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রিজার্ভ তেলের দখল পেতে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিস্তারিত আলোচনা ও পরিকল্পনা সংযুক্ত করা হয়েছে। (ওয়াশিংটন পোস্ট, ১২ জানুয়ারি ২০০২)।
হামলার পর ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ‘উম্মাত’ নামক পাকিস্তানভিত্তিক একটি দৈনিক পত্রিকায় ওসামা বিন লাদেন সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্ববাসীকে নিশ্চিত করতে চাই, সম্প্রতি যে হামলা হয়েছে আমি তার পরিকল্পনা করিনি, মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে কেউ এই হামলার পরিকল্পনা করেছে। আমি ইসলামিক আমিরাত আফগানিস্তানে বসবাস করি এবং আমিরদের আইনকানুন মেনে চলি। বর্তমান আমির আমাকে এ-জাতীয় হামলার অনুমতি দেবেন না।’
২০০১ সালের ২১ অক্টোবর ‘আল জাজিরা’ টিভি চ্যানেলে আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি ১১ সেপ্টেম্বর সংঘটিত যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সঙ্গে আমি জড়িত নই। একজন মুসলিম হিসেবে আমি মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এই হামলাগুলো সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। নিরপরাধ নারী, শিশু ও মানুষকে হত্যা করা নিন্দনীয় কাজ। ইসলাম নিরপরাধ নারী, শিশু ও মানুষকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও নিষিদ্ধ।’ এই সাক্ষাতকারটি আল জাজিরায় দুর্বোধ্য কারণে সম্প্রচারিত হয়নি, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিখ্যাত অনেক নিউজ মিডিয়া প্রচার করে। [উইকিপিডিয়া]
ওসামা বিন লাদেনের উপরোক্ত দুই স্টেটমেন্ট তাকে নিরপরাধ বানানোর জন্য যথেষ্ট নয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। ছয় সপ্তাহ অস্বীকার করার পর হঠাৎ কেন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ভিডিও টেপের মাধ্যমে ১৮০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে ঘুরে হামলার দায়-দায়িত্ব ওসামা বিন লাদেন নিজের কাঁধে তুলে নিলেন? যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে আফগানিস্তানের কান্দাহারে একটি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা এই ভিডিও টেপটি উদ্ধার করে। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, ইজরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনে ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা বা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা চালালে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত ইস্যু সামনে এলেই যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা গোয়েন্দা বাহিনী অথবা সিএনএন চ্যানেল কখনও আল-কায়দার, কখনও বা তালেবানের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের স্বীকারোক্তিমূলক বা হুমকি-ধমকিমূলক ভিডিও টেপ খুঁজে পায়। ভিডিওটির অডিও এবং ভিজ্যুয়াল কোয়ালিটি অত্যন্ত নি¤œমানের। অন্যদিকে ভিডিওতে ওসামা বিন লাদেন হিসেবে যে ব্যক্তিকে দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে আসল ওসামা বিন লাদেনের মিল নেই। ভিডিওর ব্যক্তিটি শ্যাম বর্ণের স্বাস্থ্যবান আরব, অন্যদিকে আসল ওসামা বিন লাদেন গৌর বর্ণের সিøম ফিগারের আরব। কথিত কনফেশন ভিডিওর ব্যক্তিটিকে ডান হাতে কিছু লিখতে দেখা যায়, অন্যদিকে ওসামা বিন লাদেন বাঁহাতি বলে খ্যাত। অনেক বিজ্ঞানী, সিআইএ অ্যানালিস্ট ও এফবিআইয়ের সাবেক এজেন্ট, যারা লাদেনের সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখেন এবং ইন্ডিপেনডেন্ট রিসার্চাররা এই ভিডিওটিকে মিথ্যা, ভুয়া ও বানোয়াট বলে মন্তব্য করেছেন।
(ফটোতে দেখানো এ, বি, সি ও ডি হচ্ছে আসল ওসামা বিন লাদেন; অন্য ফটোগুলো তথাকথিত কনফেশন ভিডিওর ভুয়া ওসামা বিন লাদেন)
এফবিআইয়ের ওয়েবসাইটে ওসামা বিন লাদেনকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার সন্দেহভাজনদের লিস্টে তার নাম নেই। এই বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিআইয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘কারণ নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতার কোনো শক্ত প্রমাণ এফবিআইয়ের কাছে নেই।’ (ডেবাংকিং ৯/১১ ডেবাংকিং, পৃষ্ঠা নং-২১, ড. ডেভিড রাই গ্রিফিন; অলিভ ব্রাঞ্চ প্রেস ২০০৭, ইউএসএ) ৯/১১ সন্ত্রাসী আক্রমণের বিখ্যাত অনুসন্ধানী রিপোর্টার ‘এড হাস’ বলেন, ‘বিন লাদেনের কথিত কনফেশন টেপটি নভেম্বরে নয়, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে রেকর্ডকৃত।’
যেকোনো সন্ত্রাসী হামলা যার দ্বারাই সংঘটিত হোক, তা কঠোরভাবে নিন্দনীয় ও নিকৃষ্টতম সাজার উপযোগী। কিন্তু সেই হামলা কে করেছে, কেন করেছে, কীভাবে করেছে, তার সুপ্ত ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ওসামা বিন লাদেন নয়-এগারো সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত হলে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে তার বিচার ও সাজার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু স্রেফ সন্দেহের বশে মানবতার ফেরিওয়ালাদের দ্বারা একটি দেশকে আক্রমণ! তাও আবার পৃথিবীর দরিদ্র ও দুর্বল দেশগুলোর একটি। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ স্লোগান নিয়ে যে রক্তাক্ত হোলি খেলার সূচনা হয়, সেই ধারা আজও চলমান। কে জানে কবে মিটবে তাদের রক্ত আর তেলের পিপাসা। তাদের তথাকথিত মানবাধিকার রক্ষার যুদ্ধে পরাজিত হয় মানবতা, বিধ্বস্ত হয় বিবেক, হারিয়ে যায় সহনশীলতা, সহমর্মিতা আর ভালোবাসা; জয়ী হয় পশুশক্তির হিংস্রতা, পাশবিকতা ও জঘন্যতা।
সংযুক্তি: বুশ পরিবারের সঙ্গে লাদেন পরিবারের সখ্য দীর্ঘদিনের। এটা কোনো গোপন বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ (বুশের বাবা) ১৯৯৮ ও ২০০০ সালের জানুয়ারিতে লাদেন পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। (ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০১; গার্ডিয়ান, ৩১ অক্টোবর ২০০১)। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে ২০০১ সালের ১২ জুলাই দুবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) দুর্ধর্ষ এজেন্ট ল্যারি মিশেল সাক্ষাৎ করেন। (লা ফিগরো, ৩১ অক্টোবর ২০০১; রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল, ১ নভেম্বর ২০০১) এমনকি তথাকথিত সন্ত্রাসী হামলার আগের দিন, অর্থাৎ ১০ সেপ্টেম্বরেও প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে লাদেনের ভাইয়ের বৈঠক হয়। (ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৬ মার্চ ২০০৩) হামলার সময়ও লাদেন পরিবারের কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানরত ছিলেন। দুই-চার দিন পর এফবিআইয়ের তত্ত্বাবধানে প্রাইভেট বিমান বোয়িং ৭৪৭ সৌদি আরব পাঠানো হয়। (বোস্টন গ্লোব, ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর ২০০১; নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০১ ও ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩; টামপা ট্রিবিউন, ৫ অক্টোবর ২০০১)
সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
msnoman30@gmail.com