শিশুর বিকাশে বই

অখিল পোদ্দার: বই মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। জ্ঞানের তৃষ্ণা মিটায়। বই পড়ার সুফল সুদূরপ্রসারী। তাই শিশুদের শিশুকাল থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। একটি ভালো বই মনের ক্লান্তি, জড়তা ও কুসংস্কার দূর করে নির্মল আনন্দ দান করে। বইয়ের সঙ্গে কেবল তথ্য বা জ্ঞানের সম্পর্ক নয়, একটি ভালো বই পাঠকের জানার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত ও প্রসারিত করে। বই সভ্যতার ধারক ও বাহক। বইয়ের সংস্পর্শে না এলে অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জ্ঞানলাভ করা যায় না। পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিরা বই পড়াকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

দুই যুগ আগেও মানুষ বই পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে বই উপহার দিতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততায় মানুষের বই পড়ার আগ্রহ দিন দিন কমছে। সিংহভাগ শিশু ইলেকট্রনিক যন্ত্রনির্ভর দিনযাপনে অভ্যস্ত। বই পড়া বাদ দিয়ে শিশু-কিশোররা এখন এ যন্ত্রকেই অবসর ও অবসাদ কাটানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

আগে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে মা-বাবা যেমন সন্তানদের বই উপহার দিতেন, তেমনি বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও বই বিনিময়ের প্রচলন ছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তে প্রযুক্তির আশীর্বাদে বই বিনিময় ও বই উপহার দেওয়ার প্রচলন এখন আর নেই বললেই চলে। আবার আগের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে বিশেষ করে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের বা ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকারীদের পুরস্কার হিসেবে বই ও ভালো কলম দেওয়ার প্রচলন ছিল। এখন সেটা দখল করে নিয়েছে চীনামাটির বিভিন্ন পণ্য, শোপিস বা অন্যকিছু। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বইকে প্রাধান্য দেওয়া হলে এবং বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের বাইরে নিয়মিত বই পড়ায় কার্যক্রম চালু হলে শিশু-কিশোরদের মাঝে বইয়ের গুরুত্ব যেমন বাড়বে, তেমনি বই পড়ার অভ্যাস গঠনেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ‘বইপড়া’ কর্মসূচি এবং ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন করলে শিশুরা উপকৃত হবে।

পরিবারে বড়দের দেখাদেখি আজকালকার অধিকাংশ শিশু-কিশোরের অবসর কাটে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপের মতো ইলেকট্রিক ডিভাইস নিয়ে। ফলে বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমোন্নতিতে বই পড়াটা অভ্যাসের পরিবর্তে অনেকটা প্রয়োজনে পরিণত হচ্ছে। পরিবারের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও বই পড়ার আগ্রহ গড়ে উঠছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিশুদের দৃষ্টি এখন বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের বদলে গেমস, কার্টুন, ইউটিউব, ফেসবুক প্রভৃতিতে। এতে তাদের শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের শৈশব, স্বপ্ন ও তাদের যুগান্তকারী সৃষ্টিশীল কাজ সম্পর্কে যেমন তারা জানতে পারছে না, তেমনি প্রকৃত সৃজনশীলতার প্রেরণা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। আগেকার দিনে কোনো বাংলা বইয়ে গদ্য বা কবিতা শুরুর আগে কবির আত্মজীবনী থাকত। এখন তেমনটা দেখা যায় না, ফলে শিশুরা কবির শৈশব, জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে পারছে না। শিশু-কিশোরদের পাঠের অভ্যাস গঠন, মেধা ও সৃজনশীলতার উম্মেষ এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বই পড়াটা তাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।

করোনায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে শিশুরা আরও বেশি প্রযুক্তিমুখী হচ্ছে। মূল বইয়ের সঙ্গে সংযোগ অনেকটাই কমে গেছে তাদের।

সরকার বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মুখস্থ বিদ্যার নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বিকাশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রশ্নপত্র পদ্ধতিতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর উপযোগী আনন্দদায়ক পদ্ধতি প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের মনে পাঠের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করে তাদের মেধা ও মননে সৃজনশীলতার উম্মেষ ঘটানোর প্রয়াস চলছে। এ প্রয়াস শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত বলে স্বীকৃত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই। শিশুরা প্রকৃতিগতভাবেই কৌতূহলী। তাদের আগ্রহকে জাগিয়ে তুলতে শ্রেণির নির্ধারিত কয়েকটি পাঠ্যপুস্তকই যথেষ্ট নয়। শিশু-কিশোরদের সুপ্ত চিন্তাশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হলে তাদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে শিশুতোষ বইয়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ফলে তারা যেমন নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানবে, তেমনি তাদের পাঠের দক্ষতাও উন্নত হবে। বইয়ের বিষয়বস্তু শিশুর মনোজগতে নাড়া দিলে তাদের চিন্তাশক্তি আরও প্রখর হবে, যা শিশুর সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বই যে কোনো বয়সের মানুষের আনন্দের খোরাক জোগায়। বয়সের কারণে শিশু-কিশোররা আনন্দপ্রিয়। আনন্দহীন যে কোনো কাজেই তারা অনাগ্রহী। তাদের মনে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টিতে বইয়ের চেয়ে উত্তম আর কিছুই হতে পারে না। বইয়ের ছবি, চরিত্র ও সংলাপগুলো তাদের জন্য অকৃত্রিম আনন্দের উৎস। আনন্দের পাশাপাশি বিভিন্ন আঙ্গিকের সংলাপ তাদের মেধা ও মননের উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বর্তমান আকাশসংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের আগ্রাসনে ঘরবন্দি শিশু-কিশোররা টিভির কার্টুন চ্যানেলে প্রিয় বিভিন্ন কার্টুন চরিত্রের মতো নিজেদের সাজানোর চেষ্টা করে। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের পর্দায় গেমস খেলে কৃত্রিম আনন্দ পেয়ে অবসর কাটায়। তবে এসব অনুষ্ঠান ও খেলা শিশুর সৃজনী শক্তির বিকাশে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। বরং অধিকাংশ সময় গেমসের বিভিন্ন উগ্র ও সহিংস কর্মকাণ্ডে তারা প্রলুব্ধ হয়ে বাস্তবে তা করার চেষ্টা করে। অনলাইন বা যন্ত্রনির্ভর এসব কার্যক্রম সাময়িকভাবে আনন্দের হলেও তাদের কোমল ও বাড়ন্ত মস্তিষ্কে তার নেতিবাচক প্রভাব ভবিষ্যতের জন্য বেশ ক্ষতিকর। তার পরিবর্তে বইকে তাদের অবসর ও বিনোদনের সাথি হিসেবে পরিণত করা গেলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় সময়ের জন্য তা লাভজনক। এর ফলে একদিকে তাদের অনলাইন ও যন্ত্রাসক্তি যেমন প্রশমিত করা সম্ভব হবে, তেমনি প্রশস্ত হবে মেধা বিকাশের পথও। বই পড়ার মাধ্যমে তাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। সেইসঙ্গে স্মরণশক্তি ও শব্দভাণ্ডারও প্রসারিত হয়।

শৈশব ও কৈশোরকাল ধৈর্য, সাহস, মানবিকতা, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের মতো মানবিক মূল্যবোধ গঠনের উপযুক্ত সময়। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ার জন্য আনুষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বই পড়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের লেখা গল্পের ঘটনা ও চরিত্রের মাধ্যমে কোনো শিশু বা কিশোর খুব সহজেই মানবজীবনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পারে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই শিশুদের দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে বিরাট অবদান রাখে। বই পড়াকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করতে হলে শিশু-কিশোরদের বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বই প্রাপ্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই অগ্রগণ্য।

আমাদের শিশু-কিশোরদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের বই তুলে দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকার বিগত ১১ বছরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও সরকারি গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে কয়েক লাখ বই  কিনেছে। সরকারি গণগ্রন্থাগারের ৭০টি শাখার জন্য সরকার প্রতিবছর বই কিনে থাকে। প্রতিবছরই মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যসংবলিত বই কিনে তা বিতরণের ব্যবস্থা করছে সরকার। আমাদের পরবর্তী প্রজš§কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার জন্যই সরকারের এ প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত করার জন্য আমাদের পরবর্তী প্রজš§কে অবশ্যই বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

একটি জাতির আত্মপরিচয় হচ্ছে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য। এ প্রজšে§র অনেক শিশুই জানে না কত ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের প্রিয় দেশটি পেয়েছি। আমাদের শিশুদের জানতে হবে এবং বুঝতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। আর এটা জানার জন্য প্রয়োজন বই।

শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা, শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা এবং সুস্থ সংস্কৃতির ধারক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ভালো বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও শিশুদের বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রযুক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। প্রযুক্তি আসক্তি রোধ করতে হবে পরিবার থেকেই। সরকারের প্রচেষ্টা তো রয়েছেই, একই সঙ্গে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সমন্বিত উদ্যোগে বই পড়াকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে পারলে মেধাবী, সৃষ্টিশীল ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠনের পথ সুনিশ্চিত হবে।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০