অতিথি পাখি পরিবেশের বন্ধু

সকালে ঘুম থেকে উঠে কুয়াশার চাদরে মোড়ানো প্রকৃতি জানান দেয় যে শীত এসেছে। গভীর কুয়াশার আড়ালে সূর্য খেলা করে আর বেলা ফোটার আগে কুয়াশাকে ভেদ করে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে দূর আকাশে বিরামহীন ছুটে চলে হরেক রকমের পাখি। বাংলাদেশ ও বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে পাখির কলকাকলি। কবিদের কবিতায়, শিল্পীদের গানে ও লেখকদের লেখনীর মাঝে জায়গা করে নিয়েছে পাখি ও পাখির ধ্বনি। কবি দ্বিজেন্দ্রনাথ রায় কবিতায় লিখেছেনÑ‘তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জাগে।’ এ কথার মাধ্যমেই নিবিড়ভাবে অনুভব করা যায় বাংলাদেশ তথা বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে কতটা মিশে আছে পাখির কলকাকলি ধ্বনি।

প্রতিবছর শীতের মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগমন ঘটে অতিথি বা পরিযায়ী পাখির। ঋতুচক্রের পরিবর্তনের ফলে উত্তর গোলার্ধে শীতপ্রধান অঞ্চলে যখন প্রচণ্ড বরফ পড়ে, তখন প্রচণ্ড শীতের হাত থেকে বাঁচতে দক্ষিণ গোলার্ধের উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে দলবেঁধে ছুটে আসতে শুরু করে এই অতিথি পাখি। মূলত শীত থেকে বাঁচতে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ও পর্যাপ্ত খাদ্যের সন্ধানে এই পরিযায়ী পাখির ছুটে চলা। রৌদ্রোজ্জ্বল, শ্যামল ও কোমল বাংলার প্রকৃতি যেন পরিযায়ীর পাখির অন্যতন পছন্দ। তাই তো প্রতিবছর প্রায় ৩০০ প্রজাতির মিলনমেলায় পরিণত হয় আমাদের বাংলাদেশ। আর তখন চরাঞ্চল, বিল-হাওর ও জলাভূমি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে। চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ উৎসবমুখর পরিবেশের আমেজ তৈরি করে। বাংলাদেশে অতিথি পাখির বিচরণক্ষেত্র অনেক রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, বাগেরহাটের নদীবিধৌত অঞ্চল, ময়মনসিংহের বিভিন্ন হাওর প্রভৃতি। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, উপমহাদেশে দুই হাজার ১০০ প্রজাতির পাখি আছে। এগুলোর মধ্যে সোনাজঙ্গ, কুনচুষী, খুরুলে, বাতারণ, বালিহাস, রাজহাঁস, রাজশকুন, কুলাউ, লালবন মোরগ ও বিভিন্ন জাতের বক উল্লেখযোগ্য। এই পরিযায়ী পাখিগুলো হাওরের আশেপাশে সবুজ অরণ্যে গড়ে তুলে তাদের সাময়িক বসতি। পাখি বিশারদদের মতে, ৩১৬ প্রজাতির পাখি বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশে আসে। এর মধ্যে শীতের সময় আসে ২৯০ প্রজাতির পাখি আর বাকিগুলো আসে গ্রীষ্মে। শুধু খাদ্য আর নিরাপত্তার সন্ধানে সুদূর হিমালয়, সাইবেরিয়া থেকে পাড়ি জমায় অতিথি পাখি। দীর্ঘ ৩০ হাজার মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে হয় এই পরিযায়ী পাখিগুলোকে। সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর আসতে শুরু করে পরিযায়ী পাখি, মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে আমাদের বাংলাদেশের প্রকৃতি। এর পরই আবার যাত্রা শুরু করে নিজ দেশের উদ্দেশে। তবে অনেক পরিযায়ী পাখিরই নীড়ে ফেরা হয় না। দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে অনেক পাখিই দুর্ঘটনার শিকার হয়। আবার পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে বেড়াতে এসে নিজের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। একশ্রেণির লোভী মানুষ আছে যারা পাখি শিকার করে। তারা ফাঁদ পেতে ও বিষটোপ দিয়ে নির্বিচারে পাখি হত্যা করে। আরেক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা পাখি শিকার করে তা বাজারে বিক্রি করে দেয়। এক ধরনের শৌখিন মানুষ আছে যারা পাখি পুষে, খাঁচায় বন্দি করে রাখে, আবার কারও কারও রসনা নিবারণ হয় এই পরিযায়ী পাখি দিয়ে। আমাদের হীন মানসিকতার জন্য ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে পরিযায়ীর পাখির অভয়ারণ্য। আমার ভুলে যাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই পরিযায়ী পাখি। পাখি যেমন জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে, ঠিক তেমনি পরাগায়ণে সাহায্য করে। বিভিন্ন জমিতে কীটপতঙ্গ  খেয়ে ফসল রক্ষা করে। পরিবেশের সৌন্দর্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

এই পরিযায়ী পাখি দেখতে প্রতিবছর ভিড় করে হাজারো মানুষ। শুধু শীতের সময়ই ৯৫ ভাগ পরিযায়ী পাখি সাইবেরিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে আমাদের চিরসবুজ দেশে আসে। আমরা যেমন বাড়ির অতিথিকে আপ্যায়ন করি, তেমনি আমাদের দেশের এই অতিথিদেরও আপ্যায়ন করতে হবে। আমাদের জন্য যাতে পরিযায়ী পাখির বাসস্থানের ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা আমাদেরই দায়িত্ব। বাংলার জলাশয় মুখর থাকুক পাখির কলকাকলিতে। নিজেদের পরিবেশের স্বার্থেই পরিযায়ী পাখিদের প্রতি মানবিক হওয়া জরুরি।

খন্দকার নাঈমা আক্তার নুন

শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০