নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যবসায়ীদের আস্থা ও প্রত্যাশার ওপরে সানেম ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দ্বিতীয় পর্যায়ের জরিপের ফল নিয়ে গতকাল এক ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। অক্টোবরে পরিচালিত এ জরিপের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫০২ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপরে এ জরিপটি পরিচালিত হয়। এর আগে জুলাইয়ে পরিচালিত জরিপের প্রথম পর্যায়ে ৩০৩টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করে, সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এখনও কোনো প্রণোদনা পায়নি।
‘কভিড নাইনটিন অ্যান্ড বিজনেস কনফিডেন্স: টুওয়ার্ডস ইকোনমিক রিকোভারি’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারে জরিপের ফল উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞ আলোচক ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, এ কে খান টেলিকম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম খান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, সহজ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মালিহা কাদির এবং পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ।
ওয়েবিনারে এশিয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ। প্রায় ৬০ জন গবেষক, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, উন্নয়ন কর্মী ও শিক্ষার্থী এই ওয়েবিনারে সংযুক্ত হন।
জরিপের ফল উপস্থাপনে ড. সেলিম রায়হান দ্বিতীয় পর্যায়ের জরিপ সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি জরিপ পদ্ধতিটিও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের ৩৭টি জেলার মোট ৫০২টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এই জরিপে অংশ নেয়। এর মধ্যে ২৫২টি উৎপাদন খাতের এবং ২৫০টি সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ছিল। অক্টোবরের ১৩ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে এ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদাধিকারীদের সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
জরিপে দেখা গেছে, বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের হার তুলনামূলকভাবে মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে বেশি এবং তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, ঔষধ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, রেস্টুরেন্ট, পাইকারি ব্যবসা, আইসিটি ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো অপেক্ষাকৃত দ্রুততার সঙ্গে এ পুনরুদ্ধার অর্জনে সক্ষম হচ্ছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তাদের প্রতিষ্ঠানের মুনাফা করার ক্ষমতা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, আয়, ব্যবসার খরচ এবং বিক্রি বা রপ্তানি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। উত্তর ০-১০০র একটি মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়েছে, যেখানে ০ মানে খুব খারাপ, ২৫ মানে খারাপ, ৫০ মানে কোনো পরিবর্তন নেই, ৭৫ মানে ভালো এবং ১০০ মানে খুব ভালো।
জরিপে অংশগ্রহণকৃত ৭২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এখনও কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ পায়নি। এ জরিপের প্রথম পর্যায়ে প্রণোদনা প্যাকেজ না পাওয়ার পেছনে মূলত যে কারণগুলো দায়ী ছিল যেমন কিছু খাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বিদ্যমান না থাকা, অপেক্ষাকৃত লম্বা প্রক্রিয়া ও দীর্ঘসূত্রতা, ব্যাংক-সংক্রান্ত সেবা ও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব সেগুলোয় দ্বিতীয় পর্যায়েও কোনো উন্নতি দেখা যায়নি।
জরিপের ৭১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মনে করছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে আছে, যেখানে ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী ভাবছে এই পুনরুদ্ধার হবে শক্তিশালী। অন্যদিকে মাঝারি ও দুর্বল পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার পথে আছে বাংলাদেশ, এরকম ভাবছেন যথাক্রমে ৫৭ শতাংশ ও ৩৭ শতাংশ ব্যবসায়ী।
ড. রায়হান গবেষণাপত্রের উপস্থাপনে বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকরী বাস্তবায়ন ও সঠিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় পর্যায়ের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দেখা গেছে, মাত্র ১৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের সাহায্য নিয়েছে; যা প্রথম পর্যায়ে জরিপে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রায় ১৪ শতাংশ কম। অন্যদিকে প্রথমবারের ৫৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান যেখানে সাহায্য নেয়নি, সেখানে এবার এর সংখ্যা প্রায় ৭২ শতাংশ।
প্যানেল আলোচনায় ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ জরিপের যে ফল উঠে এসেছে সেটি আমাদের করোনার কারণে পরিবর্তিত বাজার ব্যবস্থার নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ভূমিকার পরিবর্তন জরুরি। একইসঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
ড. মনসুর বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রণোদনা হতে হবে সুনির্দিষ্ট খাতভিত্তিক, যেখানে অগ্রাধিকার দিতে হবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানদের। তিনি বলেন, ব্যাংকের অর্থায়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে তারল্য সংকট নেই কিন্তু বিভিন্ন জরিপের থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী মাত্র ৫০ শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা বাজারে ছাড়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশের থেকে ভালো করলেও তা সরকারের বর্তমান প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির তুলনায় যথেষ্ট নয়।
আবুল কাশেম খান তুলে ধরেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বর্তমান প্রতিকূল অবস্থা এবং একই সঙ্গে এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেন প্রণোদনা প্যাকেজের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারছে নাÑসে ব্যাপারে তিনি প্রশ্ন করেন। বিশেষত প্রয়োজনের সময় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে অর্থ সাহায্য নিতে পেরেছে কিনা এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি সম্পর্কে নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট পরিমাণ অবগত কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন রেখেছেন। তিনি প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা এবং প্রণোদনা প্যাকেজের বর্ধিতায়নের দাবি জানান।
আসিফ ইব্রাহীম তার বক্তব্যে করোনার সময়ে সার্বিক অর্থনীতির ডিজিটালাইজেশনের ওপর গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি ট্রেড লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে অন্যান্য বক্তাদের বক্তব্যের সঙ্গে সমর্থন করেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার তৈরির আহ্বান জানান তিনি।