নিজস্ব প্রতিবেদক: অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, খাদ্য ব্যবস্থার নিরাপত্তাহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব, আবাসন সংকট এবং জীববৈচিত্র্য কমার কারণে বাংলাদেশের শহরগুলো ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে বলে অভিমত করা হয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক সেমিনারে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের এই সেমিনারে উপজেলা পর্যায় থেকে নগর পরিকল্পনা ও বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়ন নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস উপলক্ষে গতকাল বিআইপি ‘জনস্বাস্থ্যের জন্য নগর পরিকল্পনা’ শিরোনামে ওয়েবিনারটি আয়োজন করে।
সেমিনারে যোগ দেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, ব্র্যাক-আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক লিয়াকত আলী এবং বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক একেএম আবুল কালাম।
সেমিনারে সভাপতিত্ব ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপি সভাপতি আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম জনবহুল ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ; একই সঙ্গে আমরা এখন মধ্য আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার যাত্রাপথে আছি। উচ্চ নগরায়ণের প্রভাবে আমাদের শহরগুলো ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। দ্রুত নগরায়ণের ফলে যানজট, জলাবদ্ধতা, পরিবেশ দূষণÑযথা বায়ু, পানি, শিল্প ও শব্দদূষণ, বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা, সবুজায়ন হ্রাস পাওয়া, প্রাকৃতিক জলাধারের দখল-দূষণ এবং নগর এলাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সংক্রামক-অসংক্রামক সব ধরনের রোগ দিনে দিনে বাড়ছে এবং একই সঙ্গে নগর জীবনের চাপ, উদ্বেগ প্রভৃতির সামষ্টিক প্রভাবের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
আগামী দিনের বাংলাদেশে বাসযোগ্য নগর ও জনবসতি গড়ে তুলার লক্ষ্যে জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে বলে জানান আকতার মাহমুদ। পরে বিআইপির পক্ষ থেকে নানা সুপারিশও উপস্থাপন করেন তিনি।
জনস্বাস্থ্যের জন্য নগর পরিকল্পনা ও করণীয়গুলোÑ১. ভবনগুলোর ভেতর সূর্যের আলো, বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করতে ইমারত সংশ্লিষ্ট আইন-বিধিবিধান ও নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। ২. সব শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ, পার্ক, জলাশয়, উদ্যানের ব্যবস্থা এবং সেখানে সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। ৩. মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সামাজিকায়নের সুযোগ বৃদ্ধি করতে গণপরিসর, বিনোদন সুবিধাদি, কমিউনিটি সেন্টার তৈরি এবং নিয়মিত সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করার মাধ্যমে মানবিক জনবসতি ও সমাজ তৈরি করা। ৪. কঠিন ও পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্ন এলাকা ও পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও জনবসতির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।
৫. যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করার পাশাপাশি নগর এলাকায় সবার জন্য সাশ্রয়ী ও অভিগম্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সামাজিক বৈষম্য দূর করা। ৬. সবার জন্য সাশ্রয়ী ও মানসম্মত আবাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা। ৭. নগর এলাকার বিদ্যমান নাগরিক সেবা ও কমিউনিটি সুবিধাদি, সড়ক ও ড্রেনেজ অবকাঠামো, পার্ক-খেলার মাঠ-জলাশয়-উম্মুক্ত স্থান প্রভৃতির পরিমাণের ওপর কাক্সিক্ষত জনসংখ্যা এবং এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ধারণ করার মাধ্যমে নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
৮. বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, শিল্প দূষণসহ সব ধরনের পরিবেশ দূষণ বন্ধ করার মাধ্যমে নগর এলাকায় বসবাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে টেকসই ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন করা।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে বিআইপির ভাইস প্রেসিডেন্ট আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। উপযুক্ত ভূমি ব্যবহার ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নগরে বাসযোগ্যতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করতে হবে।
‘এছাড়া সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকল্পে নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে পার্ক, খেলার মাঠ, জলাধারসহ উম্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক একেএম আবুল কালাম বলেন, ‘নগরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে নগর পরিকল্পনাকে গুরুত্ব না দিলে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না করলে মানববসতির নানা সমস্যা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশগত ঝুঁকি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।’
জনস্বাস্থ্য থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত সেক্টরে পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক, মানসিক, পরিবেশগত জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নগরীর বস্তির বাসিন্দাদের জীবনমান নিয়ে আলোকপাত করেন ব্র্যাক-আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ‘বস্তিতে যারা বসবাস করে তাদের কথা মাথায় রেখে জনকেন্দ্রিক পরিকল্পনা করতে হবে। বস্তিতে আলো-বাতাসের স্বল্পতা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা অসম্ভব। এছাড়া কভিড মহামারির ফলে নতুন বর্জ্য যুক্ত হয়েছে, যার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, ‘একটি নগরের স্বাস্থ্যসহ জলবায়ু, আবাসন এবং পরিবহন ব্যবস্থা পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে।’
গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ বলেন, ‘একটি শহরের সব সংস্থার যেমন যারা স্বাস্থ্যসেবা দেবেন, আবাসান তৈরি করবেন, পরিবহন ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করবেন এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে ভালো পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকতে হবে, তবেই নগরের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’