আয়নাল হোসেন: ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেল বা গেস্ট হাউসে থাকা-খাওয়া বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সে অর্থ চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের পেছনে ব্যয় হয়নি। ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লোপাট হয়ে তা চলে গেছে কিছু ব্যক্তির পকেটে। কেবল কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কপপ্লেক্সেই নয়, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কভিডের বরাদ্দ লোপাট হয়েছে বলে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ এসেছে।
চলতি বছরের ৮ মার্চ দেশে কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। ২৫ মার্চ সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। পাশাপাশি কভিড চিকিৎসার জন্য সরকার জরুরি ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ করে। মূলত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে নিয়োজিতদের পরিবারের সদস্যদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা ও চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের আইসোলেশন নিশ্চিত করতে তাদের হোটেল-রেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ উপজেলাতেই ভালোমানের হোটেল-রেস্ট হাউস নেই। যেগুলো আছে, সেগুলো রাতযাপনের জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়। তাই চিকিৎসকরা ওইসব হোটেলে থাকতে অনীহা প্রকাশ করে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় আইসোলেশন নিশ্চিত করেন। এ সুযোগ অর্থ লেনদেনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা সরকারের বরাদ্দ করা অর্থ লোপাটের সুযোগ পান। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ অভিযোগ উঠেছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তারা হোটেল-রেস্ট হাউসের বিপরীতে কক্ষ ভাড়া, খাওয়া ও অন্যান্য খরচের ভুয়া বিল-ভাউচার দাখিল করে অর্থ লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ জুলাই ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. শামীমা শিরীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অর্থ) বরাবর কভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসাসেবা-সংক্রান্ত তথ্য পাঠান। লিখিত ওই তথ্যে জানানো হয়, কালীগঞ্জের রাহমানিয়া হোটেলে চলতি বছরের ১৩ জুন থেকে কভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত ছয়জন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স ও অন্যান্য ১২ জন স্বাস্থ্যকর্মী অবস্থান করেন। এতে হোটেলে থাকাবাবদ ৫৭ হাজার ৬০০ টাকা, খাওয়াবাবদ ৯৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আর কভিড-সংক্রান্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ ১ এপ্রিল থেকে ৬৬ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এসব বিষয়ে মোট বিল ভাউচার তৈরি করা হয়েছে তিন লাখ টাকার। এ অর্থ ব্যয় দেখানো হয় ৩০ জুনের পূর্ব পর্যন্ত, যা বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বরাদ্দের অন্তর্ভুক্ত। আর জুলাই থেকে পরবর্তী সময়ের জন্য চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের অধীনে বরাদ্দ দেওয়া হবে। হাসপাতালটিতে ২ এপ্রিল থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত ৯৬ জন কভিড-১৯ রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে বলে লিখিতপত্রে জানানো হয়েছে।
৩০ জুনের আগ পর্যন্ত চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের পেছনে যে তিন লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, তার পুরোটাই লোপাট হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ এসেছে। পরে এ বিষয়ে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী জানান, তারা কভিড ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালনকালে কখনও হোটেল বা গেস্ট হাউসে ছিলেন না। কারণ যে হোটেলটিতে থাকা বাবদ বিল পরিশোধের কথা বলা হয়েছে, সেখানে অবস্থান করার মতো পরিবেশ নেই। জানতে চাইলে রাহমানিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন শেয়ার বিজকে জানান, প্রথমদিনে কয়েকজন নার্স ছিলেন। কিন্তু কোনো ডাক্তার ছিলেন না। আর হোটেল ভাড়াবাবদ তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তিনি তিন হাজার টাকা পেয়েছেন। ৫৭ হাজার টাকার বিলের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
হোটেল বিল ও খাওয়া খরচবাবদ কোনো অর্থ ব্যয় না করেই বিল তুলে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. শাশীমা শিরীন বলেন, অভিযোগটি তিনিও শুনেছেন। তবে তা সত্য নয়। রাহমানিয়া হোটেলে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যরা অবস্থান করেছেন এটা সত্য। ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ এখনও তাদের কাছে টাকা পাবে। ডা. শামীমা শিরীন আরও জানান, তার সময়ে হাসপাতালটিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। জাইকার সহায়তায় পুরো হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। তার হাসপাতালে ৫০০ করোনা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
একই কৌশলে অর্থ লোপাট হয়েছে ময়মনসিংহের জেলার ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানকার একজন চিকিৎসক জানান, ত্রিশাল এলাকার মৌসুমী হোটেলে অবস্থান করা হয়েছে মর্মে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা তার কাছ থেকে নোটশিটে স্বাক্ষর নিয়েছেন। তবে তিনি কখনোই কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে ওই হোটেল বা গেস্ট হাউসে ছিলেন না। ওই খাতে কোনো অর্থও তিনি হাতে পাননি বলে জানান।
কেবল এ দুটি হাসপাতালেই নয়, আরও অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এভাবে অর্থ লোপাট হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালক (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম-এমআইএস) ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে কভিড রোগীর সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্টাফদের কোয়ারেন্টাইনে অবস্থানকালীন হোটেল বা গেস্ট হাউসের বিল কোনো ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়নি। এটা শুধু প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে কিছুটা অনিয়ম হতে পারে বলে জানান তিনি।
গত ১৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ডা. মো. আমিনুল হাসান স্বাক্ষরিত এক জরুরি নির্দেশনায় বলা হয়, কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার জন্য হাসপাতালে কর্মরত সব সেবাপ্রদানকারীদের সমন্বয়ে তিনটি টিম গঠন করতে হবে। প্রতিটি টিমে সমানসংখ্যক অধ্যাপক বা কনসালট্যান্ট বা বিশেষজ্ঞ মেডিকেল অফিসার, নার্স এবং অন্যান্য সেবাপ্রদানকারীরা অংশ নেবেন। প্রতিটি টিম একসঙ্গে ১০ দিন দুই-তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করবে অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা বা আট ঘণ্টার রোস্টার করে দায়িত্ব পালন করবে। দায়িত্ব চলাকালে টিমের সব সেবা প্রদানকারী পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার জন্য গেস্ট হাউস বা হোটেলে অবস্থান করবেন। গেস্ট হাউস বা হোটেল জেলা কমিটির সহায়তায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করবে। প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া যাবে। ১০ দিন দায়িত্ব পালন পরবর্তী স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরবর্তী ১৪ দিন হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। ইচ্ছা করলে কোয়ারেন্টাইন শেষে পরবর্তী ছয়দিন পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করা যাবে। তারপর পুনরায় হাসপাতালে যোগ দিতে হবে। এক টিমের কোয়ারেন্টাইন চলাকালে অন্য টিম এসে কাজ করবে এবং প্রত্যেক দিন রোস্টার ডিউটি শেষে হোটেলে অবস্থান করবে। হোটেলে অবস্থান, যাতায়াত এবং খাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক প্রেরিত চাহিদাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দ করবে।
অর্থ লোপাটের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশিদ আলম বলেন, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে হোটেলে কিংবা গেস্ট হাউসে অবস্থান নিয়ে অনিয়মের বিষয়টি এখনও তার কাছে আসেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে করোনাভাইরাস রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এরপর দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হয়। কভিড ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের পরিবারের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য তাদের ১৪ দিন হোটেল বা গেস্ট হাউসে থাকার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণা অনুযায়ী সরকার প্রজ্ঞাপনও জারি করে।