মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: বিশ্বে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলছে করোনাভাইরাসের ভয়াল তাণ্ডব। করোনার ছোবলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব দেশের সব খাত। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। করোনার প্রভাব পড়েছে দেশের সব খাতে। সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবস্থায় রয়েছে পুঁজিবাজার। অন্যান্য খাতে করোনার বৈরী প্রভাব থাকলেও পুঁজিবাজারে এর প্রভাব পড়েনি। বরং এই সময়ে লেনদেন সূচক বৃদ্ধি, বিনিয়োগকারী বৃদ্ধিসহ আরও অনেক দিক দিয়ে এগিয়েছে পুঁজিবাজার।
চলতি বছরের ৮ মার্চ করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আতঙ্কে পুঁজিবাজারে আসা বন্ধ করে দেন বিনিয়োগকারীরা, যে কারণে লেনদেন অনেক কমে যায়। অন্যদিকে এ সময় পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইতালিসহ আরও কয়েকটি দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ৩১ মে থেকে আবারও লেনদেন চালু হয়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে পুঁজিবাজারে চাঙা ভাব ফিরে আসে।
এ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনা ছুটির পরবর্তী সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছে ৮০৬ পয়েন্ট। ৩১ মে ডিএসইর প্রধান সূচকের অবস্থান ছিল চার হাজার ৬০ পয়েন্টে, গতকাল যা স্থির হয়েছে চার হাজার ৮৬৬ পয়েন্ট। এ সময়ের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি।
এদিকে গত ছয় মাসের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বাজার মূলধন। ৬৬ দিনের ছুটি কাটিয়ে ৩১ মে লেনদেন শুরুর দিন ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ডের মোট বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ১৬ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। গতকাল তা বেড়ে হয়েছে তিন লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ফান্ডের বাজার মূলধন বেড়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে সরকার তথা বিএসইসির কিছু পদক্ষেপের কারণে বাজার এমন পরিস্থিতিতে গেছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এ সময়ের মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে আইপিওর অনুমোদন দেয়া হয়। বর্তমান কমিশনের আমলে যেসব কোম্পানির আইপিও অনুমোদন মিলেছে, সেগুলো হচ্ছে মীর আখতার হোসেইন, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ডোমিনোজ স্টিল, রবি আজিয়াটা, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, লুবরেফ বাংলাদেশ, এএফসি হেলথ, তাফিকা ফুডস, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ এবং এনআরবি কর্মাশিয়াল ব্যাংক। এ সময়ের মধ্যে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ওয়ালটন।
এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করে বিএসইসির নতুন কমিশন ১৩টি প্রতিষ্ঠানের আইপিও আবেদন বাতিল করেছে। জানা যায়, আর্থিক হিসাব, আয়-ব্যয় এবং সম্পদের মিথ্যা বা সন্দেহজনক তথ্য দিয়ে আবেদন করার কারণে এসব কোম্পানির আইপিও বাতিল করা হয়েছে। বিএসইসির শীর্ষ পদে রদবদলের আগে আইপিও আবেদন ছিল ৩২টি। এর মধ্যে থেকে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের আইপিও আবেদন বাতিল করে বিএসইসি।
আইপিও বাতিল হওয়া কোম্পানিগুলো হচ্ছেÑগার্ডিয়ানা ওয়্যারস, বিডি পেইন্টস, বোনিতো এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ, বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল, এসএফ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, হজ্জ ফাইন্যান্স, থ্রি এঙ্গেল মেরিনার্স, ইনফিনিটি টেকনোলজি ইন্টারন্যাশনাল, বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং, আল-ফারুক ব্যাগস, ডেল্?টা হসপিটাল এবং নিয়ালকো অ্যালোস।
বিএসইসি সূত্র জানায়, যেসব কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করা হয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই নিয়ম মেনে আবারও আবেদন করতে পারবে। তবে তখন তাদের ক্ষেত্রে কঠোর যাচাই-বাছাই করা হবে।
আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত তথ্যসংবলিত কোনো আইপিও প্রসপেক্টাস অনুমোদনের জন্য কমিশনে জমা দিতে পারে না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু যেসব কোম্পানির আইপিও বাতিল হয়েছে, সেগুলোর সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানগুলো সব তথ্য সঠিক বলে ছাড়পত্র দিয়েছিল। এমনকি অডিটর প্রতিষ্ঠানগুলোও আর্থিক প্রতিবেদনের অসংগতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু বিএসইসি এসব তথ্যে গড়মিল খুঁজে পায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে এসব আবেদন বাতিল করা হয়। আগামীতে এ ধরনের গড়মিল পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার এবং অটিড ফার্মগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে বিএসইর নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, কোনো কোম্পানি মানহীন মনে হলে বা কাগজপত্রে ঝামেলা থাকলে আমরা তা বাতিল করছি। পাশাপাশি সবকিছু ঠিক থাকলেই কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন কমিশন ক্ষমতা নেয়ার পর দ্রুত সময়ে সবচেয়ে বেশি আইপিও অনুমোদন দিয়েছে। এর পাশাপাশি দ্রুত সময়ে সবচেয়ে বেশি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করেছে কমিশন, যা আগে কখনও দেখা যায়। কমিশনের এই ধরনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজার সংশ্লিষ্টরা।
একই প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, অনেক কোম্পানিই পুঁজিবাজারে আসে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য। বাজার থেকে টাকা নিয়ে তারা আর কোম্পানির উন্নয়নের কথা ভাবে না। মূলত এই এই ধরনের কোম্পানিই ভুল তথ্য প্রদান করে বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে বিএসইসি যে পদপেক্ষপ নিয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। বাজার ভালো হওয়ার জন্য এটা ইতিবাচক হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে করোনাকালে গত আগস্ট মাসে ‘বিশ্বসেরা’ খেতাব পেয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এই মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করেছে। পারফরম্যান্সে শুধু শীর্ষ স্থানটিই দখল করেনি বাংলাদেশের পুঁজিবাজার, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনামের চেয়ে অনেকে এগিয়ে রয়েছে।
গত আগস্টে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ উত্থান হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনামের পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। সাত দশমিক ৪০ শতাংশ উত্থানের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে ছিল রোমানিয়া। বর্তমানেও খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। বর্তমানে এশিয়ায় সবচেয়ে বিনিয়োগযোগ্য অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার।