পলাশ শরিফ: নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কড়াকড়ির জেরে ব্যবস্থাপনা ব্যয় ইস্যুতে বিপাকে রয়েছে দেশে ব্যবসারত বিমা কোম্পানিগুলো। প্রায়ই জরিমানার মুখে পড়ছে কোম্পানিগুলো। এরই মধ্যে ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত গড়িয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোও চাপে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আইডিআরএ নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমার অতিরিক্ত অর্থ খরচ করলে করারোপের বিধান চালু করা হয়েছে। বিষয়টিকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি ‘বিদ্যমান আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক’ উল্লেখ করে কর প্রত্যাহার চান বিমা খাতের উদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ ও জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ে বিতর্ক চলছে। এমন অবস্থার মধ্যেই কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যয়ের ওপর ৪০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে, যা বিদ্যমান ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি এটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বিদ্যমান আয়করের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। আর নতুন করের বোঝার কারণে বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরও বাড়ছে। বাড়িতে অর্থের জোগান দিতে গিয়ে বিপাকে বিমা কোম্পানিগুলো। তাই প্রাক-বাজেট প্রস্তাবনায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ওপর আরোপ করা কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিমা খাতের কোম্পানিগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)।
ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ওপর বিদ্যমান কর প্রসঙ্গে বিআইএ প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়টি নিতান্তই বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র বিষয়। তারা নির্দেশনা লঙ্ঘনের জন্য কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। অন্যদিকে যেহেতু ব্যবস্থাপনা ব্যয় সম্পর্কিত নির্দেশনাটি সময়োপযোগী নয়- তাই সংশোধনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আয়করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। ব্যয়ের ওপরে কর দিতে হবেÑ এমন নির্দেশনা আয়কর অধ্যাদেশ ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরোপ করা করের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সে কারণেই আমরা ওই করের বোঝা সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছি। ওই করের কারণে কোম্পানিগুলো আরও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে।’
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, বিমা কোম্পানির অনুমোদনযোগ্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অঙ্ক ২০১০ সালের বিমা আইনের ৬৩ ধারা ও ১৯৫৮ সালের বিমা বিধির ৪০ ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের বিমা বিধির এ সংক্রান্ত ধারাটি ১৯৯৪ সালের পর আর সংশোধন করা হয়নি।
তাই পুরোনো ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনি নির্ধারিত সীমায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে কোম্পানিগুলো। অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অভিযোগে পুরোনো ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানিকে কয়েক বছর ধরে জরিমানা-শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝিতে দুর্নীতি দমন কমিশনও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। এর জের ধরে আস্থার সঙ্কটে পড়েছে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে পুরোনো আইন মেনেই সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করার তাগিদ দিচ্ছে আইডিআরএ। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য কিছু কিছু কোম্পানিতে নিরীক্ষকও নিয়োগ করছে সংস্থাটি।
সূত্রগুলো বলছে, বিমা কোম্পানিগুলো অনুমিত ব্যয়সীমার চেয়ে বেশি ব্যয় করলে ২০১০ সালের বিমা আইনের ১৩০ ধারা অনুসারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা কোম্পানিকে জরিমানা করতে পারে। কিংবা অতিরিক্ত খরচ মওকুফ করার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমার বিষয়টি সংশোধনের দাবি তুলছেন বিমা কোম্পানির দায়িত্বশীলরা। বিআইএ’র পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কয়েক দফায় সুপারিশও করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা জীবন বিমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় ইস্যুতে ধীরগতিতে হাঁটছে। র্অমন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে আইন সংশোধনের বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।
বিআইএ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আহসানুল ইসলাম টিটু শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোম্পানির আয় থেকে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বাদ দেওয়ার পর যে পরিচালন আয় নিরূপিত হয়- তার ওপরেই কেবল নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হয়। কিন্তু বিমা কোম্পানির ক্ষেত্রে ভিন্ন নিয়ম-কানুন দেখছি। এখানে ব্যবস্থাপনার পেছনে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার ওপরেই ৪০ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। বিদ্যমান বিমা আইনে আয়কর নিরূপণের যে বিধান সেটি আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও সেই বিধান মেনেই কর দিতে হচ্ছে। যেহেতু বিমা কোম্পানিগুলো নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করছে, তাই তাদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আয়কর নির্ধারণ করা যেতে পারে।’
অন্যদিকে সাধারণ বিমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় বিষয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই প্রবিধান প্রকাশ করে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। অর্থমন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ব্যয়সীমার চেয়েও আইডিআরএ ব্যয়সীমা কমিয়ে দেওয়ার কারণে ওই নির্দেশনার পরই সমালোচনার মুখে পড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনার পর, সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রণালয়ে এ সভায় ওই প্রবিধান বাতিল করে আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে নতুন প্রবিধান প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই সভায় গড়া এ সংক্রান্ত কমিটিকে বিমা খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন প্রবিধান না হওয়া পর্যন্ত সাধারণ বিমার ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার কথাও বলা হয়েছে।
Add Comment