সিপিডির গবেষণা : এখনও পরিদর্শন হয়নি এক হাজার কারখানা

নিজস্ব প্রতিবেদক: রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর থেকে বিদেশি ক্রেতাদের সমন্বয়ে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে কারখানা পরীক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এখনও এক হাজার কারখানায় কোনো ধরনের পরিদর্শন হয়নি। ওইসব কারখানার অবস্থা ও তার শ্রমিকদের কোনো ধরনের  ডেটাবেজও নেই। এসবের অধিকাংশই মাঝারি ও ছোট মাপের কারখানা। আর এমন কারখানায়ই শ্রমিক অসন্তোষ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর গুলশানে গার্ডেনিয়া গ্র্যান্ড হলে সিপিডি ও বিশ্ব শ্রম সংস্থার (আইএলও) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপে গতকাল রোববার ‘তৈরি পোশাক খাত নিয়ে সামাজিক সংলাপ’ শীর্ষক আলোচনায় এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

পোশাক খাতের অবস্থা উন্নয়নে শ্রমিক পক্ষ, উদ্যোক্তা, বিদেশি ক্রেতা ও সরকারি পর্যায়ে কার্যকর সংলাপ হচ্ছে না বলে মত দিয়ে বলা হয়, সংলাপের মাধ্যমেই খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চার বছর অতিক্রম উপলক্ষে আয়োজিত এ সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বিশ্ব পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় (গ্লোবাল ভ্যালু চেইন) এক ধরনের অন্যায্যতা আছে। বাংলাদেশ থেকে একটি তৈরি পোশাক পাঁচ ডলারে কেনে বড় ব্র্যান্ডগুলো। তারপর তা বিশ্ববাজারে ২৫ ডলার কিংবা এর বেশি দামে বিক্রি হয়। তাহলে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ওই ২০ ডলার কোথায় যায়? এ অন্যায্য ব্যবস্থা অর্থনৈতিক কাঠামোগত এক সমস্যা।

অধ্যাপক সোবহান আরও বলেন, রানা প্লাজার মতো বৃহৎ দুর্ঘটনায়ও জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনায় হয়নি। রাজনৈতিকভাবে যে নজরদারির প্রয়োজন, এক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। আমরা যতই আলোচনা করি না কেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। আমি নিশ্চিত, যখনই চাপ কমে যাবে তখনই এসব সমস্যার আবার আবির্ভাব হবে।’

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্যরে সঞ্চালনায় সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি তার প্রবন্ধে বলেন, রানা প্লাজার শ্রমিকদের অনেকেই এখনও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। অনেকে আর্থিক সংকটে ভুগছে। বেকার রয়েছে বড় একটা সংখ্যা। সব মিলে তাদের ক্ষতিপূরণে এখনও অনেক কিছু করার রয়েছে। অন্যদিকে দুর্ঘটনার পর থেকেই পোশাক খাতে নিরাপদ পরিবেশ নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরীক্ষণ করা ১৩৩টি কারখানা নিরাপত্তার পরিবেশ উন্নয়ন করতে পেরেছে। ৩৯টি কারখানা পুরোপুরি এবং ৪৭টি আংশিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ১০৪টি কারখানায় সংস্কারের শর্তে উৎপাদন চলছে। এছাড়া ১৯৫টি কারখানার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তারা। ওই কারখানাগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা দরকার বলে মত দেন তিনি।

তিনি বলেন, একইসঙ্গে সরকারি উদ্যোগে দেড় হাজার কারখানা পরীক্ষা করা হলেও এক হাজার কারখানায় কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো সবই ছোট ও মাঝারি আকারের। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ছোট-মাঝারি কারখানাগুলোতেই শ্রমিক অসন্তোষ বেশি। ঢাকার কারখানাগুলোতে অসন্তোষ বেশি হলেও চট্টগ্রামের কারখানায় অসন্তোষ কম। এসবের কারণ সম্পর্কেও অনুসন্ধানের আহ্বান জানান তিনি।

গবেষণার অপর পর্বে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইএলও’র সঙ্গে বাংলাদেশের ২০১৩ সালে সই করা ‘টেকসই চুক্তির’ (সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট) অধীনে ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা ও সংলাপের পরিবেশ উন্নয়ন করা দরকার। এজন্য শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন করার গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।

এ সময় অন্যদের মধ্যে আইএলও’র বাংলাদেশ প্রধান শ্রীনিবাস রেডি, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার, বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের ডেপুটি হেড ইয়োগান হেইম্যান, বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান ভূঁইয়াসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের ডেপুটি হেড ইয়োগান হেইম্যান বলেন, আগামী ১৮ মে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এবং এর কর্মপরিবেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আলোচনা হবে। সেই বৈঠকের ফল যদি নেতিবাচক হয়, তবে ইউরোপের বাজারে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাংলাদেশ পায়, তাতে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হবে। তবে এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার বলেন, ‘শ্রমসচিব হিসেবে এ বিষয়ে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী। আশা করি, উন্নয়ন সহযোগীদের বোঝাতে সক্ষম হবো।’

শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার বলেন, সামাজিক সংলাপের কথা বলে ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। এভাবে সংলাপ ব্যর্থ হলে তারপর কী হবে তা স্পষ্ট করা দরকার। শ্রমিকদের সংগঠন ইন্ডাস্ট্রি অল কাউন্সিলের নেতা কামরুল আলম বলেন, ‘শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে। পার্টিসিপেটরি কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়ন এক নয়। পার্টিসিপেটরি কমিটিতে সদস্য মনোনীত হতে হবে ইউনিয়নের প্রতিনিধির মাধ্যমে। তিনি বলেন, সংসদে শ্রমিকদের বিষয়ে আলোচনা হয় না। কারণ, সংসদও মালিকদের দখলে।’

শ্রমিকনেতারা আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা এখনও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাননি। তাদের পুনর্বাসন-প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে নিতে হবে। বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, বিজিএমইএ শ্রমিক ইউনিয়ন চায় না এমনটা ঠিক নয়। ৫৯১টি কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। এর মধ্যে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করা দারকার। তিনি আরও বলেন, পোশাক কিনতে ক্রেতারা বেশি পয়সা দেবেন না। বেশি পয়সার জন্য চাপ দিলে ক্রেতারা ইথিওপিয়া যাওয়ার কথা বলবেন। ভারত পোশাক খাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। সেখানে বিপুল সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সেটা বাংলাদেশের শিল্পকে চাপে ফেলছে। এ অবস্থাও মাথায় রাখা জরুরি। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, পরিদর্শন না হওয়া এক হাজার কারখানা পরিদর্শনের জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু তার জন্য আইএলও অর্থ দেয়নি। এ নিয়ে আমরা চেষ্টা করছি।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০