এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে

নিশাত মাহজাবীন: হবিগঞ্জের মাধবপুরে গত ২৪ জানুয়ারি ঘুমন্ত দুই বোন হাবিবা ও আয়েশার ওপর এসিড নিক্ষেপ করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ আছিয়া নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করে। এসিড হামলার ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে তমাল নামে এক যুবকের ওপর এসিড নিক্ষেপের ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ ঘটনার এক বছর পর পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে।

নারীরা শুধু নয়, পুরুষ ও শিশুরাও এসিড সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। দেশজুড়ে এসিড সন্ত্রাস-বিরোধী নানা প্রচার-প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও এসিড সন্ত্রাস চলছেই। এসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় একজন মানুষের জীবনে যে ছন্দপতন ঘটে, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমানভাবে। আক্রান্তরা হারিয়ে ফেলে আত্মবিশ্বাস ও জীবনযাপনের আগ্রহ। হতাশায় কাটে তাদের জীবন।

এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন এএসএফের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছর দেশে ১৮টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে ২২ জন। ২০১৮ সালে ৩৮টি ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছিল ৪৪ জন। এভাবে প্রতি বছরই কমবেশি এসিড হামলার ঘটনা ঘটছে। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়ে অনেক নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও সারা জীবনের ক্ষত নিয়ে মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়।

দেশে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমলেও এখনও সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। ফলে এ বিষয়ে সমাজে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। জমিসংক্রান্ত কোন্দল, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার, যৌতুক, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, প্রেম কিংবা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, পারিবারিক সহিংসতা প্রভৃতি কারণে এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে থাকে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এসিড সন্ত্রাস দমন ও নিয়ন্ত্রণের আইন থাকলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের অভাব, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বন্ধ হচ্ছে না এসিড সন্ত্রাস। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, সাক্ষী না পাওয়া কিংবা ভিকটিম মামলা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হওয়ায় এসিড নিক্ষেপের প্রায় ৭০ শতাংশ ঘটনায় আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

এএসএফের মতে, দেশব্যাপী সবার প্রচেষ্টায় এসিড সন্ত্রাস কমানো গেলেও শূন্যের কোঠায় নামানো যায়নি। এখনকার পরিস্থিতি ধরে রাখতে গেলেও সামাজিক আন্দোলন জোরদারসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এর মধ্যে অন্যতম। একসময় গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত প্রচারণা ছিল। এই প্রচারণার পাশাপাশি এসিডবিরোধী আন্দোলনকে ফের জোরালো করতে হবে।

পশাপাশি এ কথাও সত্য, বাংলাদেশে এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা মূলত কমে গেছে কঠোর আইন, এসিড কেনাবেচার লাইসেন্স বাধ্যতামূলক থাকার বিধান, জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক প্রতিরোধের কারণে। অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবে মামলার সাক্ষীরা পিছিয়ে যায়, কারণ সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি আইনে উল্লেখ করা হয়নি। ‘এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২’ অনুযায়ী ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে এ-সংক্রান্ত মামলার বিচারকাজ শেষ করার কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক মামলার রায় হতে কয়েক বছর লেগে যায়। আবার রায় হলেও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়াতে ঘটছে বিলম্ব। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৯ বছরে দেশে মোট এক হাজার ৬৩৭টি এসিড সন্ত্রাসের মামলা হয়। মামলার চার্জশিট দাখিল হয় ৯৭৯টিতে আর ৬৪০টির চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়, যার মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১০২ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়।

২০০০ সালের পর দেশে এসিড সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করলে এসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকার ২০০২ সালে ‘এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন’ ও ‘এসিড অপরাধ দমন আইন’ নামে দুটি আইন প্রণয়ন করে। এসিড নিক্ষেপকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়। এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা হয় ২০১০ সালে। এসিড নিক্ষেপে মৃত্যু হলে এসিড অপরাধ দমন আইনের ধারা ৪(এ) অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। আহত কিংবা সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি নষ্ট হলে একই শাস্তির বিধান রয়েছে। শরীরের কোনো অঙ্গের বিকৃতি ঘটলে অনধিক ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত বা সাত বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

এএসএফের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী এসিড বিক্রি হওয়ার কারণ এবং উদ্বৃত্ত এসিড সংরক্ষণের ওপর যেভাবে মনিটরিং করার নির্দেশ আছে, তা যথাযথভাবে পালন হচ্ছে না। এসিড সন্ত্রাস বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর ও সংবেদনশীল হওয়াসহ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির মতে, অনেকেই জানে না এসিড সন্ত্রাসের মামলা সরকার পরিচালনা করে। তাই তারা ব্যক্তিগতভাবে মামলা করে তা চালিয়ে নিতে পারে না। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রচারণা ও সচেতনতা সৃষ্টি খুবই জরুরি। অনেকেই জানে না এসিড সন্ত্রাসের মামলা আপসযোগ্য মামলা নয়।

এসিড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের যে স্থানেই ঘটুক না কেন, এএসএফ যাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানতে পারে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এসিডদগ্ধ ব্যক্তিকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে পারে, এ লক্ষ্যে তারা কাজ করে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব এএসএফের হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এএসএফ মামলাগুলো সহযোগী সংস্থার কাছে পাঠিয়ে মামলার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, আক্রান্তদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং এসিড-আক্রান্তদের পরিবারকে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা দেয়। আক্রান্ত ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বৃত্তি দেয়া এবং দক্ষতা, উন্নয়নমূলক ও কাজভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজনসহ তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। এসিড সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি, অপরাধীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন এবং বিনা লাইসেন্সে এসিড বিক্রি প্রতিরোধসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকে। এছাড়া পোস্টার, লিফলেট, স্টিকার, তথ্যপুস্তিকা, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড তৈরি এবং জাতীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এসব উপকরণ বিতরণ করে মানুষকে সচেতন করে এএসএফ।

এসিড সন্ত্রাস রোধে সরকার অত্যন্ত কঠোর। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সরকার আইন প্রণয়ন করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। অনেক ঘটনায় আক্রান্তরা ভয়ে অথবা লোকলজ্জার কারণে আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করা দরকার। তথ্যপ্রযুক্তির অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। ইন্টারনেট পরিষেবা গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে অথবা জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করেও যেকোনো ব্যক্তি প্রয়োজনীয় পরামর্শ পেতে পারে।

এসিড সন্ত্রাস একসময় ভয়াবহ রূপ নিলেও সরকারি-বেসরকারি প্রচার-প্রচারণা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপের কারণে এর ভয়াবহতা অনেক কমে এসেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই এসিড সন্ত্রাস শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক, যা মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। মানবিকতাবোধ এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবই মূলত এর প্রধান কারণ। সামাজিক সুখ, শান্তি ও অগ্রগতি ব্যাহত করে এসিড সন্ত্রাস। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর সহযোগিতায় নিশ্চয়ই একসময় এসিড সন্ত্রাস সমূলে নির্মূল করা সম্ভব হবে। 

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০