সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৮২ শতাংশ হয় সমুদ্রপথে। প্রতি বছর সমুদ্র বাণিজ্যের আকার বাড়ছে। এতে বছরে সমুদ্রে পণ্য পরিবহনে ব্যবসা হয় প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবে এ খাতে বাংলাদেশের বাজার অংশীদারিত্ব তলানিতে। যদিও বর্তমানে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মালিকানায় মোট ৬৩টি সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ আছে। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের আঙ্কটাডের ‘রিভিউ অব মেরিনটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০২০’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান চিহ্নিত হয়নি। এ তালিকায় শীর্ষে চীন।
জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশন কনফারেন্স অব ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড) কর্তৃক প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে, পতাকাবাহী সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ মালিকানায় শীর্ষ দেশ চীন। দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির বহরে সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ আছে মোট ছয় হাজার ৮৬৯টি। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে গ্রিস। দেশটির বহরে সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ আছে মোট চার হাজার ৬৪৮টি। আর তিন হাজার ৯১০টি সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ থাকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে জাপান।
অপরদিকে এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিকে। এ তালিকায় মোট পতাকাবাহী সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ নিবন্ধনের সংখ্যা দেখানো হয় ৫২ হাজার ৯৬১টি। এদিকে নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, দেশে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মালিকানায় মোট ৬৩টি সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ আছে। এরমধ্যে বেসরকারি শিল্পগ্রুপ কবির গ্রুপের বহরের আছে ২১টি, আকিজ গ্রুপের ১০টি, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের আটটি, মেঘনা গ্রুপের সাতটি, বিএসএ গ্রুপের পাঁচটি, ক্রাউন গ্রুপের চারটি, বসুন্ধরা গ্রুপ, কর্ণফুলী গ্রুপ, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের দুটি করে জাহাজ আছে এবং ওরিয়ন গ্রুপের একটি জাহাজ আছে।
এ খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেসরকারি খাতে জাহাজের মালিকানা ও পরিচালনা ব্যবসার ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। প্রায় ৩৭ বছর আগে সমুদ্রগামী জাহাজের ব্যবসায় প্রথম যুক্ত হন তৎকালীন মাসরিকি জুটমিলের স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী খন্দকার মাহতাব উদ্দিন। দুটি জাহাজই ছিল বিদেশি পতাকাবাহী। তবে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের পথিকৃৎ এটলাস শিপিং লাইনস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সানাউল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৮ সালে প্রায় ১০ হাজার টন ধারণক্ষমতার ‘এমভি আল সালমা’ জাহাজ নিবন্ধনের মাধ্যমে এ ব্যবসার যাত্রা হয়। পর্যায়ক্রমে এ প্রতিষ্ঠানের বহরে যোগ হয় আরও ছয়টি জাহাজ।
এরপর পর্যায়ক্রমে আবুল খায়ের চৌধুরীর সমুদ্রযাত্রা শিপিং, ওয়াসিউর রহমান চৌধুরীর একুয়াটিক শিপিং, আবদুল আউয়াল মিন্টুর (সিংহভাগ অংশীদার) বেঙ্গল শিপিং এবং শাহ আলমের কন্টিনেন্টাল লাইনার এজেন্সি যুক্ত হয় এ খাতে। এসব কোম্পানির মধ্যে এখন শুধু কন্টিনেন্টাল লাইনার এজেন্সির জাহাজের মালিকানার ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো জাহাজের মালিকানা ব্যবসা থেকে সরে এসেছে।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একজন শিপিং ব্যবসায়ী বলেন, ১৯৯৪ সালে জাহাজ ব্যবসাকে সরকার শিল্প হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ শিল্প ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজি বিনিয়োগ করে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিপিং ব্যবসায়ীরা নিজের দেশ থেকে যেভাবে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে বাংলাদেশে তা নেই বললেই চলে। এছাড়া এ খাত পুঁজিঘন হওয়ায় সরল সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে হবে। প্রাণোদনাসহ অন্যান্য শিল্পগুলো যে রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে সেটা তো তাদেরও পাওয়া উচিত। এছাড়া সরকারের উচিত পলিসিগত সাপোর্ট বাড়ানো। তাহলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদ সাব্বির বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান আমদানি রপ্তানির পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া বাবদ প্রচুর অর্থ বিদেশি জাহাজ মালিকরা নিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ পরিবহন ব্যয় অদূর ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাবে। কেননা দেশের অর্থনেতিক আকারও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দেশের বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন ধরণ ও সাইজের ন্যূনতম ৪০-৫০টি জাহাজ থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূল কারণে বিশেষ করে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে না পারায় সে পরিমাণ জাহাজ করপোরেশনের বহরে সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের সুযোগ্য দিক নির্দেশনা ও সক্রিয় সহযোগিতায় এ সংস্থা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের উন্নয়ন সহযোগী এবং ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্বমানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং সংস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মিশ্র বাণিজ্যিক জাহাজ বহর সৃষ্টিসহ আনুষঙ্গিক নানাবিধ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১২ নভেম্বর ২০১৯ জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (সংরক্ষণ) আইন ২০১৯ পাস হয়। এর মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ অগ্রাধিকার পাবে।