ইসমাইল আলী: গত বছরের আগস্টে রেলের বহরে যুক্ত হয়েছে ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন। তবে এগুলোয় দরপত্রের শর্তানুসারে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংযোজন করেনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে ওই কমিটি নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কারণ ইঞ্জিন কেনায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রেলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
এদিকে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহে অভিযুক্ত হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে তদন্ত কমিটি যোগাযোগ করলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। এতে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি ইঞ্জিনের মূল্যও পরিশোধ করেননি প্রকল্প পরিচালক মো. নূর আহাম্মদ। এতে আগামী জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
যদিও ইঞ্জিনের মূল্য ছাড় করাতে নানা ধরনের তদবির করে যাচ্ছে হুন্দাই রোটেম। এ বিষয়ে দেশটির দূতাবাস থেকেও রেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে নিযুক্ত কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জাং কেইন গতকাল রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
সূত্রমতে, হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন কোম্পানি সিসিআইসি যোগসাজশের মাধ্যমে নিম্নমানের ইঞ্জিন রেলওয়েকে সরবরাহ করেছে। তবে এর সঙ্গে রেলওয়ের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গত ৯ ডিসেম্বর ‘রেলওয়ের ১০ ইঞ্জিন কেনায় অনিয়ম: নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এদিকে গত ১৩ অক্টোবর ইঞ্জিন সরবরাহে অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হলেও নভেম্বরের শেষে এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়। তিন সদস্যের ওই কমিটিতে রয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন-১), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন অধ্যাপক ও রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস)।
যদিও এ অনিয়মের সঙ্গে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত মহাপরিচালককে (আরএস) তদন্ত কমিটি থেকে বাদ দিতে গত সপ্তাহে রেলপথ মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছেন ১০ ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প পরিচালক।
এদিকে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের বিষয়ে জানতে চেয়ে হুন্দাই রোটেম ও সিসিআইসিকে চিঠি দিয়েছিল তদন্ত কমিটি। হুন্দাই রোটেম এখনও এর কোনো জবাব দেয়নি। তবে প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন কোম্পানি সিসিআইসি সম্প্রতি তদন্ত কমিটিতে তাদের জবাব দাখিল করেছে। এতে দেখা যায়, অলটারনেটর, মূল ইঞ্জিন ও ট্রাকশন মোটর কোনোটিই চুক্তির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনায় কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে ২০১৮ সালের ১৭ মে চুক্তি করে রেলওয়ে। এ চুক্তিমূল্য ছিল তিন কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ ডলার। ইঞ্জিনগুলো প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করার জন্য সিসিআইসির সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে। ইঞ্জিনগুলো জাহাজীকরণের আগে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে বলে পিএসআই সার্টিফিকেট প্রদান করার কথা কোম্পানিটির।
যদিও সিসিআইসি কখনোই রেলওয়েকে অবহিত করেনি যে, চুক্তির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো তৈরি করা হচ্ছে না। বরং ইঞ্জিনগুলোয় নিম্নমানের ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট সংযোজন করার বিষয়টি তারা বরাবরই গোপন করে গেছে। এছাড়া রেলওয়ের একাধিক টিম হুন্দাই রোটেমের কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিসিআইসি ইঞ্জিনগুলো ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোয় কখনোই রেলওয়ের টিমকে পরিদর্শনে নিয়ে যায়নি। সর্বশেষ যখন হুন্দাই রোটেম তাদের কারখানা পরিদর্শনের জন্য রেলওয়ের কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানায়, তখন কভিড-১৯ কোরিয়ায় ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। তাই ইঞ্জিনের গুণগত মান নিশ্চিতে রেলওয়েকে সিসিআইসির ওপর নির্ভর করতে হয়। এ সুযোগে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে ইঞ্জিনগুলো তৈরি করে হুন্দাই রোটেম।
তথ্যমতে, ইঞ্জিনগুলোয় টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করা হয়েছে, যা পুরানো মডেলের ও কম ক্ষমতার। এছাড়া মূল ইঞ্জিনটি ইএমডি’স ৮-৭১০জি৩বি-টিআই মডেলের হওয়ার কথা ছিল। তবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইএমডি’স ৮-৭১০জি৩বি-ইএস মডেলের ইঞ্জিন সরবরাহ করেছে। আর ট্র্যাকশন মোটর এ২৯০৯-৯ মডেলের পরিবর্তে ২৯০৯ মডেল সংযোজন করা হয়েছে।
যদিও হুন্দাই রোটেম এসব ত্রুটি দূর না করে বিভিন্ন অপকৌশলে চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ বিল তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এজন্য ইঞ্জিন কেনায় ঋণদাতা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ছাড়াও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছে হুন্দাই রোটেম। এছাড়া কোরিয়ার দূতাবাসের কর্মকর্তারা প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে প্রকল্প পরিচালক তাদের জানান, যদি হুন্দাই রোটেম চুক্তির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সব পার্টস বদলে দেয়ার জন্য সম্পূরক চুক্তি করে, তবেই তাদের চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ সরবরাহ করা হবে।
এসব বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক মো. নূর আহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের একজন তদন্ত কমিটিতে থাকায় আপত্তি তোলা হয়েছে। কারণ এতে সুষ্ঠু তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে রেলওয়ের মহাপরিচালক বা রেলপথ সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান ও রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।