সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত পোশাক খাতের বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের যন্ত্রপাতিসহ পুরো কারখানা নিলামে তুলেছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবে দুই বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটির কাছে বেপজার পাওনাসহ বিভিন্ন পক্ষের পাওনা প্রায় ২০ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের তেমন আগ্রহ নেই। সব মিলিয়ে বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানটি নিলামে বিক্রয়ের জন্য ক্রেতা খুঁজছে বেপজা।
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম ইপিজেডের চার নম্বর সেক্টরে অবস্থিত পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেড। কয়েক বছর আগে পরিচালনাগত ব্যর্থতায় বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানির কার্যক্রম। এরপর থেকে মালিকপক্ষও আড়ালে চলে যায়। সেই থেকে প্রতিষ্ঠানটির কারখানার যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন সামগ্রী পড়ে আছে। এছাড়া বেপজাসহ ব্যাংক, বিমা, শ্রমিক, সরবরাহকারীদের পাওনা অপরিশোধিত রয়ে যায়। এসব নিয়ে কারখানা মালিকদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে ইপিজেড কর্তৃপক্ষ পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের যন্ত্রপাতিসহ পুরো কারখানা নিলামে তুলেছে। এর মধ্যে আছে যন্ত্রপাতি, স্থাপনা, মজুদকৃত পণ্যসহ সব ধরনের স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পত্তি, যা আগামী ২১ জানুয়ারি থেকে সরাসরি দেখা যাবে। একই সময়ে কেনার জন্য আবেদন করা যাবে। আর আগ্রহী ক্রেতাদের আবেদন আগ্রহীদের উপস্থিতিতে আগামী ১ ফেব্রæয়ারি যাচাই-বাছাই করা হবে।
জানা যায়, বিদেশি ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী সংস্কারকাজ করতে না পারায় মিথুন নিটিংকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ফলে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বন্ধ করে দেন। এতে ক্রমাগত লোকসানের কারণে আড়াই বছর আগে মিথুন নিটিং তাদের গার্মেন্ট কারখানাটি বন্ধ করে টেক্সটাইল অংশটি চালু রেখেছিল। এরপর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল এবং প্লটের লিজ বাবদ বকেয়া কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় গত ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরের বেপজা মিথুন নিটিংয়ের সব ধরনের সেবা সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয় মালিকপক্ষ।
একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএসই ও সিএসইতে নোটিস দিয়ে মিথুন নিটিং তাদের উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। মূলত ইউরোপের পোশাক ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ডের কালো তালিকাভুক্ত হয়ে ক্রয়াদেশ হারানোর কারণে কারখানাটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে মালিকপক্ষ। সিইপিজেডের চারটি প্লটের ওপর গড়ে তোলা কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শ্রমিকদের পাওনাও বকেয়া রয়ে যায়। এসব নিয়ে বেপজার সঙ্গে বৈঠকে বসলেও কোনো সমাধান হয়নি।
মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িংয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ছিল পাঁচ দশমিক সাত মেট্রিক টন ফেবিক্স এবং পাঁচ হাজার পিস গার্মেন্ট পণ্য। শতভাগ বিদেশে রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানটিতে ৭৬৪ জন কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছিলেন। তবে পুরোনো যন্ত্রপাতি হওয়ার কারণে প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া যেত না। আর আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংকট ছিল। এতে কর্মী ও উৎপাদন কমতে থাকে। যদিও ২০১৭-১৮ অর্থবছরের কোম্পানিটির মোট বিক্রয় ছিল প্রায় ৪৪ কোটি টাকা। তবে নিট লোকসান ছিল সাত কোটি ২৭ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরের প্রায় ছয় কোটি টাকা লোকসান ছিল।
জানতে চাইলে মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের কোম্পানির সচিব মোহাম্মদ সোহেল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শুনেছি কারখানা নিলামে উঠেছে। মূলত অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের চাপের কারণে কার্যাদেশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর বেপজার অনেক পাওনা জমে গেছে। তারা গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পর গত ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে কারখানা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক ও শ্রমিকের কিছু পাওনা বকেয়া আছে। এসব নিয়ে বেপজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিবার মিটিং হলেও সমাধান হয়নি।’
নতুন কোনো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা আছে কিনাÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের পর কোনো এজিএম হয়নি। আর বোর্ড মিটিংয়ে আলোচনা হলেও কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। সুতরাং এ মুহূর্তে তেমন কিছু বলার মতো নেই। মনে হয় এটা নিয়ে আর কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। তবে গ্রæপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার মধ্যে মোটামুটি চলছে।’
নিলামের বিষয়ে বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর শেয়ার বিজকে বলেন, বেপজা ও শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রæয়ারি মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের লিজ চুক্তি বাতিল করা হয়। দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত না হওয়ায় কোম্পানিটি নিলামে বিক্রির জন্য গত ১৩ জানুয়ারি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের প্রায় দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও বেপজার বকেয়া প্রায় ১৮ লাখ ৬৭ হাজার ডলার।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারের মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেড ১৯৯৪ সালে তালিকাভুক্ত হয়। ৮০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের জেট ক্যাটেগরির কোম্পানিটির সর্বশেষ ২০১৬ সালে ২০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়। এরপর আর লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৬৭ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ।