মহসিন মিলন, বেনাপোল (যশোর): দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পণ্য আমদানি বেশি হয়। আর রপ্তানি হয় আমদানির এক-চতুর্থাংশ। তবে করোনাকালে এ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বাড়লেও রপ্তানি কমে গেছে। ফলে বিগত ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ১০৬ কোটি টাকারও বেশি। এমনকি লোকসান হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এ বন্দর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে গত পাঁচ বছরে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ৮৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮১১ মেট্রিক টন পণ্য। বিপরীতে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে ১৮ লাখ ৭২ হাজার ২১০ টন। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি করা হয় ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩২৯ টন পণ্য। আর রপ্তানি করা হয় তিন লাখ ২৫ হাজার ৩৮১ টন পণ্য।
এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৯ টন, রপ্তানি করা হয় তিন লাখ ৫২ হাজার ৯৬৩ টন পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ২১ লাখ ৮১ হাজার ১২৩ টন, রপ্তানি করা হয় তিন লাখ ১১৭ টন পণ্য। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪ টন পণ্য। আর ভারতে রপ্তানি করা হয় তিন লাখ ১৬ হাজার ৯৫০ টন পণ্য। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে আমদানি করা হয়েছে ১৭ লাখ পাঁচ হাজার ১১৩ টন এবং রপ্তানি করা হয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ২৯৫ টন পণ্য।
সূত্র জানায়, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে শিল্প কারখানায় ব্যবহƒত কাঁচামাল, কেমিক্যাল, মেশিনারি যন্ত্রাংশ, সুতা, ট্রাক চেসিস, মোটরসাইকেল, টায়ার-টিউব, বিভিন্ন প্লান্টের মালামাল ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য। এছাড়া রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য, মাছ, মেলামাইন, তৈরি পোশাক, খাদ্যদ্রব্য, ঝুট ও টিস্যুর মতো পণ্য।
জানা গেছে, বর্তমানে বেনাপোল বন্দরের স্থল ও রেলপথে ভারতের সঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি ও আট হাজার কোটি টাকা পণ্য সেদেশে রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানি করা পণ্য থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয়। তবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা ছয় হাজার ২৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু বিগত ছয় মাসে এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ১০৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘ভারত থেকে দেশের স্থলপথে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়, তার ৭০ শতাংশ হয় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে।
বেনাপোল বন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, ‘বন্দরে আমদানি পণ্যের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য ব্যবসায়ীদের দাবি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বন্দরের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় খোলা আকাশের নিচে কোটি কোটি টাকার পণ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। রোদ-বৃষ্টিতে পণ্যের যেমন গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে, তেমনি চুরি হচ্ছে প্রকাশ্যে। ক্রেন ও ফর্কলিফটের সংকট রয়েছে দীর্ঘদিনের।’
স্থলবন্দর ব্যবহারকারীরা জানিয়েছেন, বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক শহর কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ পথে প্রথম থেকেই ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি। তবে এ বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীদের আরও বেশি পণ্য আমদানির ইচ্ছা থাকলেও অবকাঠামোগত নানা সমস্যায় বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে না। লোকসান হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এ বন্দর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। ফলে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে আমদানির ওপর। তবে রপ্তানি বাড়ছে ধীরে ধীরে এ বন্দরটি দিয়ে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হলে আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্যও আরও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার হচ্ছে না। আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান (বিবিআইএন) চারদেশীয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বেনাপোল বন্দরের অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদেরও।’ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় সম্ভব বলে তিনি জানান।
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, ‘বেনাপোল বন্দর সম্প্রসারণে নতুন কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অধিগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। আমদানি করা পণ্যের নিরাপত্তায় বন্দরের চারপাশ দিয়ে উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করে সিসি ক্যামেরা বসানোর প্রক্রিয়া চলছে।’
বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের বৈধ সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষকে অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধির জন্য একাধিকবার পত্র দিয়েছি। বন্দরের সক্ষমতা বাড়লে বেনাপোল দিয়ে পণ্য আমদানি বাড়বে এবং রাজস্ব আয়ও বাড়বে।’