প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ গাঢ়। আর একেই জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও মহান চিন্তাবিদরা আমাদের মগজ-চালানের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, প্রযুক্তির ক্ষিপ্রতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, এখনকার কৈশোরে যে কোনো হিসাব মুখে মুখে মিলিয়ে ফেলার প্রচলন গত হয়েছে। তারা হয়ে পড়ছে যন্ত্রনির্ভর। এখনকার শিশুরা যন্ত্র ছাড়া চলতে চায় না। চাইলেও পেরে ওঠে না। এক গবেষণায় জানা গেছে, ৩২ হাজার বছর আগে চার প্রজাতির মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে রয়েছি শুধু আমরাই। প্রযুক্তিনির্ভর বস্তুর ওপর নির্ভরশীলতাই হয়তো হবে আমাদেরও বিলুপ্তির কারণ।
অবস্থা এমনই যে, কোনটা রেখে কোনটা ধরি? কোনটাই বা কাজে লাগাই? এ পরিস্থিতি কি মস্তিষ্কের উন্নয়নে খুব কাজে লাগে? বরং এর ফলে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে চিন্তার নানাবিধ ক্ষমতা। হারিয়ে যেতে পারে আমাদের দরকারি মেধার খোরাক।
আমরা পাঁচটি ইন্দ্রিয় শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠি। এগুলো আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। তবে যে উপায়ে এখনকার শিশুরা তথ্য-বিনোদন পায়, বেড়ে উঠছে একে অপরের সঙ্গে, গত ১০ বছরে তার বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। বলা যায়, গত ৫০০ বছরেও এমন পরিবর্তন আসেনি আমাদের জীবনে। বাস্তবিকই ত্বরিৎ গতিতে বদলে যাচ্ছে কৈশোরের সময়। যার প্রভাব পড়ছে বয়ঃসন্ধিতে। উঠতি বয়সের মানুষের জন্য এটা বোঝা নাকি আশীর্বাদ! অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, কৃত্রিমতা বিবর্জিত মানুষ যারা একসঙ্গে একটি মাত্র কাজ করতে অভ্যস্ত, তারা সমাজে কম গুরুত্ব পাচ্ছেন।
বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ যন্ত্রের আবিষ্কারই হচ্ছে ‘বিনোদন মূল্য’ প্রেক্ষিতে। তাই বলা হয়, আধুনিক উদ্ভাবন হচ্ছে সস্তা বিনোদনের পূর্বপুরুষ। চিন্তা করে দেখুন, একজন কনজিউমারের ইন্টারনেটের প্রয়োজন নেই। অথচ যেইনা উপলব্ধি করছেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার কাজ সহজ হচ্ছে এবং দ্রুত অন্যের সঙ্গে যোগযোগ স্থাপন করতে পারছেন, হাসিল হচ্ছে তার কাজ, অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এর ব্যবহারের প্রতি। একই অবস্থা সেলফোন, স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেটের ক্ষেত্রেও। এসব প্রযুক্তি নিজেদের সক্ষমতা ও সুবিধা প্রমাণ করতে পেরেছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নয়। নয় কোনো প্রযুক্তিগত অপূর্ণতাও। কিন্তু আমাদের সার্বিক বুদ্ধিমত্তার ওপর এর প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে গেলেই ঘটবে বিপত্তি।
হয় তো তাই আজকের প্রযুক্তিগত ‘রেভ্যুলেশন’ একবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে রূপ নেবে ‘ডেভ্যুলেশন’-এ। স্বীকার না করে উপায় নেই, আমাদের জীবনপ্রণালিকে চাপমুক্ত রাখতে একের পর এক ‘গতিময় ও সুবিধামতো’ যন্ত্র আবিষ্কার হবে। অনেক নামকরা বিজ্ঞানী একে অশুভ প্রভাব মনে করছেন। তাদের মতে, কোনো একদিন প্রযুক্তির এতটাই বাড়বাড়ন্ত থাকবে যে এর বিপরীতে আমরা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ব। একজন মানুষের সব চিন্তাচেতনা মেশিনের মধ্যে স্থাপন করা অদ্ভূত ধারণা বৈ কিছুই নয়! প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা তাই আগামী প্রজন্মের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এটা তাদের সত্যিকারের যান্ত্রিক করে তুলতে পারে। প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠার এ প্রবণতা নিজেদের সক্ষমতা নিবৃত্ত করবে। আমরা হারিয়ে ফেলব আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া দরকার। একটু ধীর, একটু মন্থর করে দেওয়া দরকার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। এর ফলে আমরা শিশুদের মাথা খাটিয়ে কাজ করার ব্যবস্থা করতে পারি। তাদের জন্য একটু চর্চার সুযোগ করে দিতে পারি।
Add Comment