স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

৬.২৯ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ৩৩৮ বিলিয়নে

ইসমাইল আলী: যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, নেই বৃহৎ কোনো অবকাঠামো, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, গুটিকয়েক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সেবা খাত গড়ে না ওঠা শুরুর গল্পটা অনেকটাই ছিল এ রকম। খুবই সাধারণভাবে যাত্রা শুরু করা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তাই নানা রকম হোঁচট খেয়েই পথ চলতে হয়। দারিদ্র্যপীড়িত ও শিক্ষাহীন জনগোষ্ঠী, সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগসহ নানা কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের নেতিবাচক উপাধিও জুটে যায় বাংলাদেশের কপালে।

যদিও এ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে অনেকটা সময় লেগে যায়। দুই দশক আগেও মনে করা হতো বাংলাদেশের অর্থনীতি হয়তো উন্নতি করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হয়তো এগিয়ে যেতে পারবে না বাংলাদেশ। যদিও ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। ৫০ বছর আগের সে চিত্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বে আজ সফল অর্থনৈতিক উদাহরণের নাম বাংলাদেশ। নানা সাফল্যের গল্পও করা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঘিরে।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২৯তম বৃহৎ অর্থনীতি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দোরগোড়ায় এসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশও পেয়েছে। অথচ ১৯৭২ সালে এ অবস্থা ধারণার মধ্যেই ছিল না, যদিও সে অসম্ভবকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ছয় দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৮ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছরে তথা সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতির এ অর্জনকে বিস্ময়কর বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ বা ’৭৩ সালে কল্পনাই করা যেত না ৫০ বছরে বাংলাদেশ কোথায় থাকবে। নানা ধরনের আশঙ্কাও করা হয়েছিল সে সময়। তবে সব ধরনের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে আজকের অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। এখন সাফল্যের বিভিন্ন ধরনের উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলনা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কোনো ধরনের অবকাঠামো ছিল না। বড় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও ছিল না। শিক্ষার হার ছিল অনেক কম। দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় শতভাগ। সেখানে থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জের। আর সেটা খুব ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ।

বহুজাতিক এ সংস্থাটির তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার মোটামুটি দ্রুত বাড়ে। মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে বিনিয়োগ করায় এটি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৪৪৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর দুই বছর তা কমে ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে এর জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ১৯৭৮ সাল থেকে আবার জিডিপির আকার বাড়তে শুরু করে। ১৯৮১ সালে তা ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৯৮২ ও ’৮৩ সালে আবার জিডিপির আকার হ্রাস পায়। এর পর থেকে নিয়মিতই বাড়ছে জিডিপি। তবে গতি ছিল কিছুটা মন্থর। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০০০ সালে এর আকার বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার।

২০০২ সালের পর থেকে জিডিপির আকার দ্রুত বাড়তে শুরু করে। সে বছর এর পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ৭২৪ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ৮১৯ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৯ সালে জিডিপির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। আর মাত্র সাত বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণের বেশি বাড়ে। ২০১৬ সালে জিডিপির আকার ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় আড়াইশ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৮ তা আরও বেড়ে হয় ২৭৪ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ সালে তা ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ২০২০ সালে জিডিপির আকার আকার বেড়ে হয় ৩১১ বিলিয়ন ডলার। মূলত করোনার কারণে জিডিপির আকার বৃদ্ধির হারে কিছুটা ভাটা পড়ে। আর চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থানের পেছনে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ের প্রথমটি ছিল কৃষিতে সবুজ বিপ্লব। আর দ্বিতীয়টি নীরব শিল্পবিপ্লব। পাশাপাশি শিল্পকে সহায়তা করতে সেবা খাতও প্রসারিত হয়েছে।

কৃষির সাফল্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক এ শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কৃষি ছিল মূলত প্রকৃতিনির্ভর। শুষ্ক মৌসুমে কোনো ফসল হতো না। অনাবৃষ্টিতে কোনো কোনো বছর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও জেঁকে বসত। আর এখন দেশের প্রায় সব জমি তিন ফসলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমেও ফসল ফলছে। প্রতি বছর আবাদি জমি হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরও চালে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, ১৯৭২ সালে যা ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়।

এদিকে বাংলাদেশের শিল্প খাতের সাফল্যকে ব্রিটেনের প্রথম শিল্পবিপ্লবের সাফল্যের চেয়েও বড় বলে মনে করে ড. জাহিদ হোসেন। এর কারণ ব্যাখ্যায় দুই দেশের জিডিপিতে শিল্পের অবদান তুলনা করে তিনি বলেন, ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সালে ব্রিটেনে প্রথম শিল্পবিপ্লব হয়। ওই সময়ে অর্থাৎ ৮০ বছরে দেশটিতে শিল্প খাতের অবদান বেড়েছিল ১১ শতাংশ। এর মধ্যে ১৭৬০ সালে ব্রিটেনের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২০ শতাংশ। ১৮৪০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ শতাংশে। আর ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান বেড়েছে ২৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল মাত্র ছয় শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ। এটা অবশ্যই শিল্পবিল্পব।

জিডিপির আকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে মোটামুটি নিয়মিতই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮) বাস্তবায়নকালে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল চার শতাংশ। আর সে সময় মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হার ছিল এক দশমিক তিন শতাংশ।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮০-১৯৮৫) বাস্তবায়নকালে এ দুই হার দাঁড়ায় যথাক্রমে তিন দশমিক আট শতাংশ ও এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮৫-১৯৯০) বাস্তবায়নকালে গড় প্রবৃদ্ধির হার অপরিবর্তিত থাকলেও মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে হয় এক দশমিক ছয় শতাংশ।

এর পর থেকে অর্থনীতির এ দুই সূচকের হার নিয়মিতই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এর মধ্যে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৯০-১৯৯৫) বাস্তবায়নকালে গড় প্রবৃদ্ধির হার চার দশমিক দুই শতাংশ ও মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হার দুই দশমিক চার শতাংশ হয়। আর পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৯৭-২০০২) বাস্তবায়নকালে এ দুই হার দাঁড়ায় যথাক্রমে পাঁচ দশমিক এক শতাংশ ও তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ।

এদিকে শেষ দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে দেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হয়েছে। এর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ সূচক দুটিতেও দেখা গেছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) বাস্তবায়নকালে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছয় দশমিক তিন শতাংশ ও মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হার চার দশমিক ৯ শতাংশ হয়। আর সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) বাস্তবায়নকালে এ দুই হার দাঁড়ায় যথাক্রমে সাত দশমিক ১৩ শতাংশ ও পাঁচ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

অর্থনীতির এ গতিকে আরও ওপরে তুলে ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। তবে এ পথে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, স্বাধীনতার ৭০ বছরের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে দুটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। প্রথমত, ৮-১০ শতাংশ হারে আগামী ১৫-২০ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধির সুফলকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই এ লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে মনে করেন তারা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০