রহমত রহমানঃ করোনা মহামারীর মধ্য মধ্যে গত এক বছর ধরেই ২৪ ঘণ্টা কাস্টমস হাউস, বিমানবন্দর ও শুল্ক স্টেশনগুলোতে সেবা দিচ্ছে কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগে নিয়োজিতরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে অভিযোগহীন সেবা দিয়ে দেশব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ। ফলে করোনা সংক্রমণরোধে সরকার ঘোষিত ‘চলাচল নিষেধাজ্ঞা’র মধ্যেও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সাপ্লাইচেইনসহ আমদানি-রপ্তানি সচল রয়েছে। রপ্তানি, ওষুধ ও অন্যান্য শিল্পের ভ্যাট আদায়, হোটেল রেস্তঁরা মনিটরিংসহ রাজস্ব সংগ্রহের জরুরী কাজে নিয়োজিত ভ্যাট বিভাগের কর্মরতরা। দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ ভ্যাটদাতার অনলাইন রিটার্ন ব্যবস্থাপনাও বিশাল কর্মযজ্ঞ।

কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লকডাউনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন সময় আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। রাতবিরাতে সড়কে চলাচলকারী কর্মকর্তাদের হয়রানির অভিযোগও রয়েছে।
## একজন কমিশনারসহ মারা গেছেন ৯জন
## সংস্পর্শে মারা গেছন পরিবারের সদস্যরা
## ২৪/৭ খোলা রাখা হয়েছে কাস্টম হাউস ও বিমানবন্দর
## মহামারিতে প্রশংসনীয় কাজ করছেন কর্মকর্তারা
## টীকাসহ জরুরি করোনা সুবিধায় নেই কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ
## প্রজ্ঞাপনে অনুলিপিতে এনবিআর না থাকায় কর্মকর্তাদের যাতায়াতে ভোগান্তি, ক্ষোভ

রাজস্ব আদায় ও এবিষয়ে সেবা দিতে গিয়ে করোনায় বিপর্যস্ত গোটা কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ। অথচ সরকার ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে জরুরি সেবার তালিকায় বন্দরের নাম থাকলেও কাস্টমস বিভাগের নাম না থাকায় এমনটি হয়েছে। জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপনে জরুরি পরিষেবার তালিকায় কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের নাম কেন নেই-এ বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেনি এনবিআরের উধর্বতন কর্মকর্তারা। করেনার টীকা গ্রহণে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জরুরি সেবাদাতার তালিকায়ও এ দুই বিভাগের নাম নেই! অনেক কর্মকর্তা এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
গত ১৩ মার্চ কাস্টমস কমিশনার হোসাইন আহমেদ করোনাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এনবিআরের হিসাবে, কমিশনারসহ করোনা আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত নয়জন কাস্টমস কর্মকর্তা কর্মচারী মারা গেছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ মারা গেছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উচ্চমান সহকারী আবুল কাশেম।
করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে পরিবারের সদস্যরাও সংক্রমিত হয়েছেন, অনেকে মারা গেছেন। দুই বিভাগে পুরুষ মহিলাসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৫ শতাধিক। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ১০ জনেরও বেশি।
এনবিআর সূত্রমতে, করোনার মধ্যেও আমদানি-রপ্তানি, ভ্যাট আহরণের প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। থেমে নেই রাজস্ব আহরণ সম্পৃক্ত সেবা ও সংগ্রহ। এনবিআরের তিন বিভাগের মধ্যে কাস্টমসের আহরণ সর্বোচ্চ ১২.১৭ শতাংশ। সারাবিশ্বে নেতিবাচক অর্থনৈতিক সূচকের তুলনায় কাস্টমসের এ অর্জন সাধুবাদ পায়।

এনবিআরের চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত (জুলাই-মার্চ) নয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ২৭ হাজার ৭৬৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা (সাময়িক)। বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৮৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। গত অর্থ বছরের তুলনায় আহরণ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরমধ্যে কাস্টমস খাতে আদায় হয়েছে ৫৩ হাজার ৯৯৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ খাতে আহরণ প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। এছাড়া ভ্যাট খাতে আদায় হয়েছে ৬৭ হাজার ৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আয়কর খাতে আদায় হয়েছে ৫৫ হাজার ৮০৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
সর্বশেষ ৪ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে সাতদিনের ‘চলাচল নিষেধাজ্ঞা’ দিয়ে ১১টি বিধি-নিষেধ জারি হয়। প্রজ্ঞাপনে জরুরি পরিষেবা হিসেবে ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন নিষেধাজ্ঞার আওতা বর্হিভূত থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। এ তালিকায় তালিকায় কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের নাম উল্লেখ নেই।

কাস্টম হাউসের একাধিক কমিশনারের সূত্রে শেয়ার বিজকে জানায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জরুরি চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবাসামগ্রী, শিল্পের কাঁচামাল, সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার আমদানি করা পণ্য, মুলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ, পোল্ট্রি, ডেইরি, মৎস্য শিল্পের খাদ্য ও উপকরণ এবং কূটনৈতিক সুবিধায় আমদানি করা পণ্য শুল্কায়নসহ খালাস প্রদান এবং পণ্য রপ্তানি ও ইপিজেডের কার্যক্রম সার্বক্ষনিক সচল রাখতে দেশের সব কাস্টম হাউস, শুল্ক স্টেশন ২৪ ঘণ্টা খোলা রয়েছে।
সূত্র জানায়, কাস্টমস হাউসে কর্মকর্তাদের আমদানিকারক-সিএন্ডএফ এজেন্টসহ অল্প জায়গায় শত শত লোকের মধ্যে সেবা প্রদান করতে হয়। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে মালামাল পরীক্ষণ করতে হয়। পণ্য খালাস সরেজমিনে তদারকি, প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম ও চোরাচালান দমন, রামেজিংয়ের জন্য গভীর সমুদ্রে বিদেশি জাহাজে গমন ও তল্লাশি করা, গেট ডিভিশন ঝুঁকিপূর্ণ কর্তব্য পালন এবং বন্দরের সাথে সমন্বয় করে পণ্যের দ্রুত খালাস করতে হয়। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আক্রান্ত হয়।
কাস্টমস সূত্র আরো জানায়, বিমানবন্দরগুলোতে প্রতিদিন শত শত বিদেশি যাত্রী হ্যান্ডেলিং ও সুচারুভাবে পারাপার, যাত্রীসেবা দ্রুতকরণ, শুল্কযোগ্য পণ্য পরীক্ষণ ও শুল্কায়ন এবং চোরাচালন দমনে কাজ করতে হয়। এছাড়া বিমানবন্দরের শত শত জরুরি কার্গো ব্যবস্থাপনা করতে হয়। সকল ক্ষেত্রে তাদেরকে মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়। এভাবে প্রচন্ড ঝুঁকিতে কাস্টমসের কর্মকর্তারা রাজস্ব আহরণে জীবনবাজি রেখে দৈনন্দিন কাজ করছে।

একাধিক ভ্যাট কমিশনার শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, করোনার মধ্যেও দেশের সব ভ্যাট অফিস খোলা রয়েছে। অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিলসহ সব ধরনের ভ্যাট সেবাসহ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছে। করোনায় ঝুঁকি নিয়েই ভ্যাট কর্মকর্তারা রিটার্ন দাখিল ও মনিটরিং করতে ছুটছে মার্কেট থেকে মার্কেটে। উৎসে ভ্যাট আদায়, ভ্যাট নিবন্ধন ও রিটার্ন দাখিল বাড়াতে একজন কর্মকর্তাকে প্রতিমাসে অন্তত দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। ভ্যাট সমগ্র ঠিক রাখতে জরীপ, নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল ও আইনি জটিলতা নিরসনে কমিশনারেটগুলো ভ্যাট মেলা ও সপ্তাহ পালন করছে। এসব সেবা দিয়ে গিয়েও বহু মানুষের সংস্পর্শে এসে কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
সূত্র জানায়, অনলাইন ভ্যাট রিটার্ন দাখিল বাড়াতে এনবিআরের নির্দেশে কমিশনারেটগুলো প্রতিযোগিতা করছে। ফলে কোন কোন কমিশনারেট মাসে ৯৮ শতাংশ অনলাইন রিটার্ন দাখিল হচ্ছে। এ অসম্ভবকে সম্ভব করতে গিয়ে করদাতাদের ডোর টু ডোর যেতে হয় কর্মকর্তাদের। এর ফলেও বহু কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন, হচ্ছেন। এছাড়া রাজস্ব ফাঁকিরোধে করোনার মধ্যেও প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হলে সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটবে। ফলে পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। আর রাজস্ব না হলে রাষ্ট্রের চাকা অচল হয়ে যাবে। কর্মকর্তারা বলেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে তাঁরা অগ্রণী ছিলেন, আছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, জরুরি সেবার তালিকায় তাদের রাখা হয়নি। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈশকালীন দায়িত্বসহ বিভিন্ন সময়ে ঘরে-বাইরে যেতে শংকিতবোধ করছেন। আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিব্রত ও নিস্পৃহ করছেন।
দেশের অর্থনীতি সচল, সময়ানুগ রপ্তানি জাহাজীকরণ, সাপ্লাইচেইন নিরবচ্ছিন্ন রাখা, বিমানবন্দর ও চেকপোস্টে যাত্রীসেবা নির্বিঘ্ন রাখাসহ জরুরি রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম সক্রিয় রাখার স্বার্থে করোনাকালের জুরুরী পরিষেবায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মাঠ পর্যায়ের কমিশনারগণ সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করা যায়।
###