শেখ আবু তালেব: ১৩ বছর ধরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালান মো. তাজুল মিয়া। রিকশা চালনার জীবিকার ওপর ভর করে উত্তরের জেলা রংপুরের এক গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বসবাস করছেন তিনি। তিন মেয়ে নিয়ে তার সংসার। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই তিনি। গতবারের লকডাউনে বাড়ির গরু বিক্রি করে চলতে হয়েছে। এবার কী হবে, তা ভেবে কূল পান না। করোনা সংক্রমণ রোধে বর্তমানে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ থাকা সত্ত্বেও পেটের দায়ে প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন তিনি।
কভিড মহামারিতে ঢাকায় চলা দুই লাখ রিকশাচালকের সংসারজীবনের কাহিনিগুলো প্রায় এরকমই। গল্পের ভিন্নতা থাকলেও আর্থিক টানাপড়েনের বিষয়টি একই। তাজুল মিয়া ছাড়াও গতকাল এ প্রতিবেদকের কথা হয় আজিজুল, আইনুল, জসিম ও আনোয়ার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে।
তারা জানান, ঢাকা শহরে মূলত রিকশাচালকরা একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভিত্তিতে চলাচল করেন। কারণ ঢাকার সব এলাকার সড়ক সব রিকশাচালকের চেনা-জানা নয়। আবার অনেক রিকশার সিটি করপোরেশন প্রদত্ত লাইসেন্স নেই। ফলে পুলিশের রিকশা জব্দ করার ঝুঁকিও রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় তারা সুযোগ বুঝে নির্দিষ্ট সড়কে চলাচল করেন। এতে করে কোনো কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রিকশা আটক করলে নেতাদের মাধ্যমে সহজে ছাড়িয়ে নিতে পারেন তারা। কিন্তু চলমান বিধিনিষেধের কারণে এখন যাত্রী পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে বলে তারা জানান।
সড়কে গণপরিবহন না থাকায় দূর-দূরান্তের যাত্রী পাওয়া যায় বেশি। ফলে অচেনা এলাকায়ও যেতে হচ্ছে তাদের। তখন যাত্রীকেই অনুরোধ করছেন রাস্তা চিনিয়ে দিতে। এর সঙ্গে বাড়তি উপদ্রব হিসেবে যোগ হয়েছে মোটরচালিত রিকশা। এতে প্যাডেলচালিত (তাদের ভাষায় বাংলা রিকশা) রিকশায় যাত্রী উঠছে কম।
রংপুরের বদরগঞ্জ থেকে ঢাকা আসা তাজুল মিয়া বলেন, ‘রিকশার দৈনিক জমা ১২০ টাকা। মালিক এখন ১০০ টাকা নেন। রোজার মাসে সারাদিন রিকশা চালানো যায় না। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালাই। জমা-খরচ বাদ দিয়ে ৩০০ টাকার মতো থাকে। জিনিসপত্রের যা দাম, এই টাকা দিয়ে চলা মুশকিল। কিন্তু কাজে না বের হলে খাব কী? পেট তো লকডাউন বুঝতে চায় না।’
কভিড মহামারির ছোবলে প্রতিদিন শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু দেখছে বাংলাদেশ। প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সরকার গত ১৪ থেকে আগামী ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। বন্ধ রাখা হয়েছে জরুরি পরিবহন ব্যতীত অন্য সব ধরনের যানবহন। এছাড়া সীমিত পরিসরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতল ও বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের চলাচলের অন্যতম বাহন এখন রিকশা।
মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে ঢাকায় এসে রিকশা চালান জসিম। গত সাত বছর ধরেই রিকশা চালান তিনি। মাঝেমধ্যে ধান কাটতেও যান গ্রামে। করোনার এ সময়ে যা রোজগার হচ্ছে, তা দিয়ে জীবন চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।
গতকাল পল্টন এলাকায় কথা হয় তার সঙ্গে। জসিম বলেন, ‘পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় রিকশা চালাই। এখন যেখানে খ্যাপ পাই, সেখানেই যাই। দুপুরে বের হয়েছি। কিন্তু এখনও জমার টাকাই ওঠেনি। এভাবে চলতে থাকলে আর বের হবো না। কোনোমতে ট্রাকে হলেও গ্রামে চলে যাব।’
আয় কমে যাওয়ার কথা জানালেন আজিজুল, আইনুল ও আনোয়ার। আজিজুল এসেছেন নীলফামারীর ডোমার থেকে। তিনি জানান, মানিকনগরের এক গ্যারেজ মালিকের রিকশা চালান তিনি। এখন জমা দেন ৮০ টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে সারাদিনের খরচ। এসব বাদ দিয়ে ২৫০ টাকার মতো থাকে। এ দিয়ে চলতে হচ্ছে। দোকানে বাকি রাখতে হচ্ছে। কোনোমতে শাক-পাতা খেয়ে জীবন চলছে।
আইনুল জানালেন পুলিশের হয়রানির কথা। তিনি বলেন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট। একটি কোনোমতে এড়িয়ে যেতে পারলেও পরেরটিতে আটক হতে হচ্ছে। লাঠির মার তো আছেই, রিকশাও উল্টিয়ে রাখছে।
আইনুল বলেন, ‘দুই ঘণ্টা রিকশা আটকে রাখলে কমপক্ষে ২০ টাকা খরচ হয়। ইনকাম তো গেল। আবার বকা-ঝকা রয়েছে। অনেক পুলিশকে টাকা দিলেও ছেড়ে দেয়। আবার কেউ টাকা নেয় না, রিকশাও ছাড়ে না। এভাবেই দিন যাচ্ছে। এজন্য যাত্রী না পাইলে বড় রাস্তায় উঠি না। গলিতেই থাকি। গলিতে তো আর ভাড়া পাওয়া যায় না।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। অনেক দিন ধরেই রিকশার নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরের পর থেকে রিকশার নতুন নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ। ২০১৮ সালে ফের শুরু হয়েছে নিবন্ধন কার্যক্রম। পুরনো তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা শহরে নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৫৪৪টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৫২ হাজার ও উত্তর সিিিটতে ২৬ হাজারের বেশি রিকশা রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন রিকশা মালিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। নিবন্ধনের বাইরে থাকা রিকশা বিভিন্ন সমিতির ব্যানারে চলে। এসব রিকশার চালকই হচ্ছেন গ্রাম থেকে আসা শ্রমজীবীরা। লকডাউনে এ বিশালসংখ্যক রিকশাচালক রয়েছেন বড় ধরনের আর্থিক সংকটে।
আবার রিকশার দৈনিক ভাড়া অর্থাৎ জমাও কমিয়েছেন অনেক রিকশামালিক। তেমনই একজন পুরান ঢাকার হাজারিবাগের রিকশা গ্যারেজ মালিক মো. সেলিমের রয়েছে ৮০টি রিকশা। গতকাল তিনি জানান, করোনায় এখন ২০টির মতো রিকশা বের হচ্ছে। একে তো রমজান, তার ওপর করোনা। দুই মিলিয়ে আয় কমে গেছে। গ্যারেজে মিস্ত্রি রাখার খরচও উঠছে না। যাত্রী না পাওয়ায় চালকরা রিকশা নিচ্ছে না। এখন আর নির্ধারিত জমার টাকা নিচ্ছি না। যে যা দিতে পারে, তাই নিচ্ছি। ৪০ থেকে ৬০ টাকাও জমা নিচ্ছি। রিকশাচালকদের দিকেও তাকাতে হবে।