আব্দুল্লাহ হেল বাকী, ধামইরহাট (নওগাঁ): নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় রয়েছে কয়েকটি কুমার পরিবার। বৈশাখ আসার কয়েক মাস আগে থেকে তাদের মাটির জিনিস তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করতে হতো। কিন্তু কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত লেগেছে বিলুপ্তির পথে থাকা মৃৎশিল্পের ওপর। লকডাউনসহ বৈশাখী মেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় কুমার পাড়ায় কর্মচঞ্চলতা নেই। গত বছরও করোনা পরিস্থিতির কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছিল।
সরেজমিনে কুমার পল্লিতে দেখা গেছে, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। একদিকে মহামারি করোনা, অন্যদিকে লকডাউন। মাটির তৈজসপত্র বিক্রি শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাওয়া এ পরিবারগুলোর কপালে পড়েছে ভাঁজ।
বাড়ির উঠানে খোলা আকাশের নিচে মাটির হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে ক্রেতাশূন্য দোকানে বসে থাকতে দেখা গেল ষাটোর্ধ্ব শ্রীমতী রজলী পালকে। দোকানে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা মাটির থালা, প্রদীপ, ভাপাপিঠার খুলিসহ অনেক কিছু পাওয়া যায় এখানে। এর অনেক কিছুই যান্ত্রিক সময়ের চাপে হারিয়ে গেছে। অথচ একসময় বাংলার হারিয়ে যাওয়া মাটির এসব জিনিস ছাড়া গৃহস্থালির কাজকর্ম করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা মাটির ব্যাংকের প্রকারভেদে দাম ১০ থেকে ৬০ টাকা, পাতিল ২০ থেকে ৪০ টাকা ও গরুর খাবারের জন্য চারি ৩০ থেকে ৬০ টাকা। এছাড়া পানি রাখার কলসি ৪০ টাকা, কবুতরের ঘর ১৫ টাকা ও পাতিলের ঢাকনার দাম ১০ থেকে ৩০ টাকা। একই সঙ্গে মাটির ফুলদানির দাম প্রকারভেদে ২০ থেকে ৫০০ টাকা, ছোট বাচ্চাদের খেলনা প্রতিটি ১০ টাকা ও মাটির থালা ৪০ থেকে ১৫০ টাকা। মগ ২০ থেকে ৮০ টাকা, ফুলের টব ২০ থেকে ১০০ টাকা, বাটনা ৩০ থেকে ৫০ টাকা, সাত পিঠার বাটি ৪০ টাকা, পানের বাটা ৩০ টাকা ও মাটির প্রদীপের দাম মাত্র ২০ টাকা রাখা হয়েছে।
তবে মাটির দুষ্প্রাপ্যতার সঙ্গে শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মাটির তৈজসপত্র তৈরি ও বিক্রিতে খুব একটা লাভের মুখ দেখছেন না তারা। তাদের অভিযোগ, সরকারের অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
মৃৎশিল্পের জাদুকর রামায়ণ প্রসাদ পাল বলেন, বাবু আমি এখন আমার বংশের ১৪তম পুরুষের হাল ধরে আছি। আমার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মহেশ কুমার পাল ও ছোট ছেলে সঞ্জয় কুমার পাল। মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য ছেলেদের কাজ করতে বললে তারা বলে, মৃৎশিল্প দিয়ে আমাদের জীবন-সংসার চলবে না। তবে আমার দ্বিতীয় ছেলে সন্তোষ কুমার পালই আমার বংশের একমাত্র শেষ ভরসা, সে আমার ১৪ পুরুষের হাল ধরে আছে।
শুধু নববর্ষ এলেই সাহেব-বাবুদের আমাদের কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে পান্তা-ইলিশে আমাদের মাটির থালা দরকার হয়। এখন কেউ মনে রাখে না। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন আমাদের দিকে নজর না দিলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। আক্ষেপ করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রজনী পাল।