রক্তিম সূর্যের আলোয় অমিত তার শক্তি

মামুনুর রশীদ: ‘জানি না আবার কখন লিখতে পারবো। আমাকে লিখো না। সোনার বাংলার জন্য সর্বোচ্চ যা পারো করো।…’ দেয়ালে লেখা একটি চিঠি। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন চিঠিটি লিখেছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমী তার মামা কামাল পাশাকে। স্বাধীন দেশে এরকম বেদনামিশ্রিত মধুর চিঠি আর কখনও লেখা হয়নি। তবে রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন একটি নাম বাংলাদেশ। রুমীর লেখা শেষ লাইন শুধু মামা পাশার জন্য ছিল না; এটি মূলত ১৬ কোটি মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে রেখে গেছেন।

তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করতেই এই চিঠির জন্ম। ২৬ মার্চের ভয়াল রাত থেকে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও বাঙালির হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়াকু সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই জাগিয়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কীভাবে লড়তে হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেটা তিনি হাতে ধরে শিখিয়েছেন বাঙালিদের।

ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যেতে থাকে। এ সময় ক্রমান্বয়ে তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার আগে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৬-দফা থেকে শুরু করে বিজয় পর্যন্ত বাঙালির হৃদয়ে সবসময় সংগ্রামী চেতনা কাজ করেছে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি নরপিশাচদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছি আমরা।

রুমীর লেখা চিঠির শেষ লাইন ‘সোনার বাংলার জন্য সর্বোচ্চ যা পারো করো’। এ বক্তব্যটি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম, তার পরবর্তী প্রজন্ম এভাবে প্রত্যেকের বিবেক নাড়িয়ে যাবে। এ পর্যন্তই কি শেষ? সোনার বাংলার জন্য আমরা কী করেছি? লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। সেই রক্তের পবিত্রতা রক্ষা করতে পেরেছি?

স্বাধীনতার ৪৫ বছর হয়ে গেল। নিজের মায়ের জন্য একবার মূল্যবান সময় দিতে পারিনি। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের রঙিন করে কী লাভ? সোনার বাংলা পেয়েছি, কিন্তু এখনও নিজের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছি। কবে আমাদের ঘুম ভাঙবে আর কবে আমরা সুন্দর সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়বো? রক্তের দাগ না শুকাতেই আমরা হারিয়েছি আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টাকে, যে ক্ষতি কখনও পূরণ হওয়ার নয়।

সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈষম্য থেকে বেরিয়ে দেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশকে দুর্বল ভেবে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী যুক্তরাষ্ট্র তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারপরও বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন আমরা দুর্বল নই আমরাও পারি। পদ্মা সেতুর কাজ আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই হচ্ছে। ৪৫ বছরে এটি আমাদের বড় প্রাপ্তি। ১১১টি ছিটমহলের জনতা মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, এটাও আমাদের বিজয়ের আরেক আনন্দ।

সারা দেশেই শহীদের রক্তে ভেজা মাটি; পা রাখার জায়গা নেই। শহীদদের রক্তের ঋণ আজও কাঁধে নিয়ে অপরাধী হয়ে ঘুরি। যে যুদ্ধের পর দেশটির আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল অর্ধশতেরও বেশি দেশের। বছর ঘুরে এলেই আমরা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের আনন্দে মেতে উঠি। লেখকদের লেখায় প্রস্ফুটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্মৃতিচারণায় পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রাখেন অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছেন, তাদের অনেকে এখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। অনেকে বিদায় নেবেন। স্মৃতি রোমন্থন যা করার, সবই করছেন প্রবীণরা। এ প্রবীণরা মারা গেলে স্মৃতি রোমন্থন করবে কি আমাদের মতো বিজয় না দেখা প্রজন্ম? তাহলে ইতিহাস তার সঠিক ঐতিহ্য হারাবে বৈকি।

মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিতরণ করা হয়েছে। দলিলপত্র বিতরণ পর্যন্তই শেষ কথা নয়। কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ দলিলপত্র পড়ানো হয়, কয়টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এ দলিলপত্র নিয়ে পাঠচক্র হয় বা ক’জন শিক্ষক দলিলপত্র খুলে নিজের জ্ঞান সমৃদ্ধ করেন? বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে দলিলপত্র

বাক্সবন্দি করাই রয়েছে।

তাহলে দলিলপত্র করে কী লাভ হয়েছে? প্রতিষ্ঠানে এরকম একটি মূল্যবান জিনিস রয়েছে, তা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জানে না। মুক্তিযুদ্ধ বস্তাবন্দি করে রাখার মতো জিনিস নয়। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে হবে। ১৫ খণ্ডের দলিলই তার সঠিক স্মৃতিবাহক। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অমলিন হওয়ার কথা। আজ ঠিক তার উল্টো ঘটছে।

নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। দেখছে চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের মতো ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসুদের যুদ্ধাপরাধের বিচার। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করতে হলে এসব বিকারগ্রস্ত ঘাতকদের কথাও উঠে আসে। এই ঘাতকরা হত্যা করেছে অনেক বুদ্ধিজীবীকে। পাকবাহিনী দিয়ে ধর্ষণ করানো হয়েছে আমাদের সম্ভ্রম। অপমান করেছে বাঙালির রক্তকে। তারা খুন করতে চেয়েছে একটি জাতিসত্তাকে, পথচলার আলোকে, অনুভব করার শক্তিকে, তারা খুন করতে চেয়েছে বাঙালির বিবেককে।

রাতের আঁধার ছিন্ন করে ভোরের রক্তিম সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা বাংলার গৌরবান্বিত বিজয়। বঙ্গবন্ধুর রণমন্ত্রে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয় পেয়েছি। যুদ্ধে শহীদদের রক্তের দাগ, বীরাঙ্গনাদের মুখগুলো দেখি পতাকায় ভেসে উঠতে। নমিত হƒদয়ে তাদের প্রতি অভিবাদনের প্রত্যয়ের মুষ্টি বিজয় দিবসে। তবে ৪৫ বছর আগের সূর্যের চেয়ে আজ বিজয়ের সূর্য একটু ভিন্ন। লাখো শহীদের রক্তমাখা, সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের বেদনার স্পর্শ নিয়েই আজ বিজয়ের সূর্য।

বিজয়ের দিনে রক্তিম সূর্যে জাতির জনকের মুখচ্ছবি দেখতে পেয়েছি? আমরা কি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দাগ দেখেছি ঘুমের মধ্যে? যদি না দেখি, তাহলে শহীদের আত্মা আর্তচিৎকার করছে। একাত্তরের অপরাধীদের কলঙ্ক মুছে ফেলার জন্যই বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। গঠন করা হয়েছে একাত্তরের অপরাধীদের বিচারে বিশেষ ট্রাইবুন্যাল, যার মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেকখানি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে সোনার বাংলা।

যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিচার শেষে এবারের বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে। যারা একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছে, আজ তারাই স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ সবক্ষেত্রেই অনেক এগিয়েছে। জাতীয় আয়, প্রবৃদ্ধি, গড় আয়, খাদ্যে পর্যাপ্ততা, নারী উন্নয়ন সূচক, ক্ষমতায়নে আমরা আলোচনায় রয়েছি।

এখনও পথ অনেক বাকি। দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে, মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে, এমন অবস্থা চাই। সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যার কলঙ্ক দূর করতে হলে সবাইকে একত্রে পথ চলতে হবে। কিছুদিন আগে ভারতের কিছু রাজ্য ভ্রমণ করে জানতে পেরেছি, আমাদের প্রতি তাদের ভালোবাসা। পাশাপাশি তাদের ক্ষোভ! কেন তাদের ভাষাকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শিখি না। আমরা কেন তাদের উন্নয়নের অংশীদার হই না!

তাদের বলেছি আমাদের ভাষা পেয়েছি কিছু বীর তরুণের রক্তের বিনিময়ে। স্বাধীনতা পেয়েছি ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দুই লাখ সম্ভ্রমের বিনিময়ে। এরপরও কীভাবে বলেন আপনাদের ভাষাকে আমাদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে? আমার ব্যাখ্যায় ভদ্রলোক চুপসে গিয়ে বিদায় নিলেন।

আমরা ভুলিনি শহীদদের শপথ। পরস্পরের কাঁধে কাঁধ রেখে লক্ষ্যে অগ্রসর হবো। বাংলাদেশ অপরাজেয়, রক্তিম সূর্যের আলোয় অমিত তার শক্তি। তরুণ প্রজন্ম জাগবে, সেই শক্তিতে সোনার বাংলা অগ্রসর হবে। এটি আমাদের প্রত্যয়।

 

শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

mamunhist39Ñgmail.com

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০