লকডাউনে ডাইন ইন সেবা বন্ধ

হোটেল-রেস্তোরাঁ কর্মীদের মানবেতর জীবনযাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড-১৯-এর বিস্তার রোধে চলমান বিধিনিষেধে হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে পার্সেল সেবা চালু রাখার অনুমতি আছে। কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণের সুযোগ না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিকিকিনি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় পরিবহন, মার্কেটসহ সেবা খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করার অনুমতি দেয়া হলেও এখনও সে সুযোগ পায়নি হোটেল-রেস্তোরাঁ। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোও মোটা অঙ্কের লোকসান গুনছে।

গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ চলমান। ওই সময় থেকেই রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তখন সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পার্সেল সেবা চালুর অনুমতি দেয়া হয়। এরপর গত ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় দফার কঠোর বিধিনিষেধ। তখন দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত রেস্তোরাঁ খোলা রেখে শুধু পার্সেল সেবা চালু রাখার অনুমতি দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, এপ্রিলের ৫ তারিখ থেকে চলা লকডাউনে সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ করার ঘোষণায় এর আওতায় পড়ে বন্ধ হয়ে যায় খাবার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো। এরপর কয়েক দফা বিধিনিষেধ বৃদ্ধির মধ্যে ধীরে ধীরে শপিং মল, দোকানপাট ও গণপরিবহন খুলে দেয়া হলেও রেস্তোরাঁগুলো খুলে দেয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। এ সময়ে কেবল ডাইন ইন বা বসে খাওয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করে পার্সেল বা টেক অ্যাওয়ে ভিত্তিতে হোটেল-রেস্তোরাঁ পরিচালনার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য খাত যেহেতু খুলে দেয়া হয়েছে, তাই জীবিকার প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হোটেল-রেস্তোরাঁও চালু করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।

এদিকে লকডাউনে রেস্তোরাঁর ডাইন-ইন সেবা বন্ধ থাকায় এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে রেস্তোরাঁ মালিক ও কর্মচারীদের ওপর। ঢাকাসহ সারাদেশে কয়েক ধরনের রেস্তোরাঁ চালু রয়েছে। এর মধ্যে লোকসমাগম বেশি যেসব এলাকায়, সেখানকার সাধারণ রেস্তোরাঁগুলোয় পার্সেল বিক্রি চালু থাকলেও অভিজাত রেস্তোরাঁগুলো বিপাকে পড়েছে।

একটি আন্তর্জাতিক চেইন রেস্তোরাঁর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে তারা রেস্তোরাঁ স্থাপন করেছেন। এ ধরনের রেস্তোরাঁয় সাধারণত পার্সেল সেবা জনপ্রিয় নয়। মূলত এসব রেস্তোরাঁর মনোরম পরিবেশে বসে খাবার গ্রহণেই ভোক্তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু লকডাউনে ডাইন-ইন সেবা বন্ধ থাকায় বিক্রি নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। ফলে বাধ্য হয়ে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এতে তারা নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। একদিকে ব্যাংকঋণের সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের লোকসান বাড়ছে হু-হু করে। এমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা বিপাকে রয়েছেন। আর প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যুক্তরাও রয়েছেন উভয় সংকটে। এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব ধরনের রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এপ্রিল মাসে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশের হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোয় প্রচুর ভিড় হয়। এ বছর লকডাউনের ঘোষণায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়, যার দরুন হয়নি কোনো আয়োজন। সাধারণত রমজান মাসে ভোজনরসিক বাঙালি অন্যান্য মাসের তুলনায় খাওয়া-দাওয়ায় বৈচিত্র্য আনে। আর এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে হোটেলে তৈরি নানা পদের বাহারি ইফতার। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে চলে ইফতারের আয়োজন। লকডাউনের কারণে এবার কোনো হোটেলেই ইফতারের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি, যা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় প্রভাব ফেলে। অন্যান্য বার এমন  ইফতার আয়োজনের মাধ্যমে বেশ বড় ধরনের আয় করে থাকেন রেস্টুরেন্ট-সংশ্লিষ্টরা, যা এ বছর এবং গত বছর বন্ধ থাকে।

রেস্টুরেন্ট বন্ধের পাশাপাশি গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবং চলাচলে সীমাবদ্ধতা থাকায় টেক অ্যাওয়ে বা পার্সেল করে বিক্রিও খুব একটা হয়নি বলে জানান রেস্টুরেন্ট মালিকরা। ঢাকার একটি স্বনামধন্য রেস্টুরেন্টের মালিক জানালেন, লকডাউনের প্রথম দিকে পার্সেল বিক্রিও ছিল না, যার ফলে তাদের তৈরি করা খাবার বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লকডাউনের তীব্রতা কমে এলে বিক্রি বাড়ে তাদের। একই অবস্থা প্রায় সব রেস্টুরেন্ট ও হোটেলের।

ঈদের আগে রেস্টুরেন্টগুলোয় ইফতার পার্টি ও সাহরি পার্টিতে জমজমাট থাকত ঢাকার অধিকাংশ রেস্টুরেন্ট ও হোটেল। এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ভোক্তাদের কাছ থেকে ভালো মানের বকশিশ পেতেন ওয়েটার-কর্মচারীরা। রেস্টুরেন্টে এসব আয়োজন বন্ধ থাকায় তাদের এই বাড়তি আয় বন্ধ হয়ে গেছে। পার্সেল ব্যবস্থার কারণে রেস্টুরেন্টের কর্মচারীর সংখ্যাও কমিয়ে দেয়ায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন অসংখ্য ওয়েটার। লকডাউনের মধ্যে তাদের জন্য অন্য কোনো কাজের ব্যবস্থাও হয়নি। এই অবস্থায় তারা পড়েছেন বিপাকে। সামনে ঈদে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দমুখর পরিবেশে ঈদ উদ্যাপন করতে পারবেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন লকডাউনে কর্মহীন হয়ে যাওয়া কর্মচারীরা।

লকডাউনে হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে ব্যাচেলর ও ভাসমান মানুষদের ওপরও। এছাড়া অসংখ্য কর্মজীবী মানুষ দুপুর ও রাতের খাবার খেতেন হোটেলে। লকডাউনের পর থেকে হোটেলে বসে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন এসব মানুষ।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লকডাউনে প্রায় সবকিছু খুলে দেয়ায় এবার রেস্টুরেন্টগুলোও খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে হোটেল মালিকরা। এরই মধ্যে হোটেল ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানান তারা। সামনের ঈদে রেস্টুরেন্ট খুলে দিয়ে এই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ দেয়ার দাবি করেন মালিক-কর্মচারীরা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০