রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: বাংলাদেশের নদী প্রণালির অন্যতম প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্র। এক সময়ের খরস্রোতা এ নদ খননের পরও ফের চর পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদের প্রসার বুকে পানির খেলা নেই, বালুচরে ঢাকা পড়েছে অতীত ঐতিহ্য। যতই বালুচর জাগছে ততই জীববৈচিত্র্য, জীবন-জীবিকার আবহমান প্রবাহ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। স্রোত হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি। বিলুপ্ত হওয়ার পথে জেলেপল্লিগুলো। সেচের পানির অভাবে নদ অববাহিকায় চাষাবাদ দুরূহ হয়ে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এই মর্মর রূপের ব্রহ্মপুত্র বর্ষায় দু’কূল উপচে প্লাবিত হয়। ভাঙনে, বানে গ্রাস করে নদপাড়ের জনপদ। ফলে এ জনপদে এখন শুধুই বিপন্নতার শঙ্কা।
ব্রহ্মপুত্র নদ খননে অনিয়মের অভিযোগে গত বছর ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে খননের নামে ব্রহ্মপুত্র নদকে খালে পরিণত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে অবিলম্বে তা বন্ধ করার দাবি জানান ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী আবুল কালাম আল আজাদ।
বক্তারা দাবি করেন, ব্রহ্মপুত্র এক থেকে দুই কিলোমিটার প্রশস্ত হওয়া দরকার। সেখানে মাত্র ১০০ মিটার খাল খনন করা হচ্ছে। যেখানে দুই থেকে তিন চ্যানেল ছিল, সেখানে মাত্র একটি চ্যানেল রাখা হচ্ছে। বাকিগুলো বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। ফলে অবৈধ দখলদারদের দখলের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন ঘটনা ঘটলেও নজরে পড়ছে না কারও।
সরকার ব্রহ্মপুত্র নদ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের যে কাজ চলছে তা এখন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে। নানা আন্দোলনের পরও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। খননের আগে নদের যে করুণ অবস্থা ছিল, বর্তমানে ঠিক তেমনই রয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, এটি কোনো ছোট প্রকল্প নয়। ছয় বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে মোট ২৮টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হয়। জামালপুরে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ থেকে শুরু হয়ে ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার নদ খননে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। ২৫টি খননযন্ত্র দিয়ে বর্তমানে খনন চলছে। এর মাঝে নদের ময়মনসিংহ অংশের ৯০ কিলোমিটার খনন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
খনন সম্পূর্ণ হলে একটি আন্তর্জাতিক নৌ রুট ও প্রকল্পের আওতায় চরম নাব্য সংকটে থাকা এ নদের হারানো যৌবন ফিরিয়ে এনে আবারও জাহাজ ও কার্গো চলাচল করতে পারবে। পাশাপাশি দুটি জাহাজ চলাচলের জন্য নদটি ৩০০ থেকে ৩৫০ ফুট প্রশস্ত ও ১০ ফুট গভীর এবং নদটির আট কোটি ঘনমিটার অংশ ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার কথা থাকলেও বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে লোকালয় বা বাজারে মোট ১৪টি ঘাট করা হবে বলে জানিয়েছিলেন বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা। কিন্তু নদটিতে বর্তমানে নৌকা চলাচল তো দূরের কথা কুকুর-গরু অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে। ধু-ধু বালু চরে ছেয়ে গেছে নদ। এমন অনিয়মে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সচেতন নাগরিক সমাজ।
পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলনের ময়মনসিংহের সভাপতি ড. মো. শাহাব উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের ব্রহ্মপুত্র খননের কাজ শুরু করেছিলেন, তা অপরিকল্পিতভাবে খননের ফলে ফের বালু দিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জনগণের টাকায় খননের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম, শুষ্ক মৌসুমে অবাধে সব ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারবে কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, এ বিষয়ে যেন দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া হয়।
ব্রহ্মপুত্র খননে অনিয়মের বিষয়ে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ’র একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
শুরু থেকে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল খননকাজে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর ও ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে। সরকারি বিধি ও দরপত্র মোতাবেক ১০ ফুট গভীরতা থাকার কথা থাকলেও সেভাবে না করে সরু খালের আকারে খনন চলছে। এ কাজ ঘিরে নগরবাসীদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
নানা অনিয়ম প্রসঙ্গে ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. এনামুল হক বলেন, খননের বিষয়ে কোনো অনিয়ম হলে আমরা খনন কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করব।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, ‘পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদীর নাব্যতা উন্নয়নে ড্রেজিং’ নামে এ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ২৪ আগস্ট পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছিল, যা শেষ হতে পারে চলতি বছরের শেষের দিকে। এর মধ্যে প্রথম দুই বা আড়াই বছরে খননকাজ শেষ করে পরবর্তী তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।