ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: কয়েক বছর ধরেই দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে ব্যক্তি খাত। ফলে এ খাতের প্রবৃদ্ধি মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখছে। আবার ভোগ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে ব্যক্তি বিনিয়োগ পরিচালিত হচ্ছে। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। সে সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভোগ ব্যয়ের অবদান নেমে এসেছে অর্ধেকে। আর বেড়ে গেছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির অবদান।
ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয় ও বিনিয়োগের এ অবস্থাকে সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। গত রোববার সংস্থাটির প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে এ-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৯০ দশকে উম্মুক্ত করে দেওয়ার পর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয় অর্থনীতিকে ৬৫-৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অর্ধেক বা তার বেশি ছিল ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি। তবে গত অর্থবছরের মতো পরিস্থিতি কখনই দেখা যায়নি। সে সময় ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধি উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেয়ে নেমে আসে তিন শতাংশে, ১০ বছরের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। তবে এর ধরনের পরিস্থিতিতে বিনিয়োগে এতটা উল্লম্ফন প্রশ্নসাপেক্ষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ ও ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের ভোগে বেশ তেজিভাব ছিল। সে সময় এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয় যথাক্রমে সাত দশমিক শূন্য পাঁচ ও সাত দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি। পরের দুই অর্থবছরও এ খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে। ২০০৯-১০ অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি আরও কমে দাঁড়ায় চার দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে এটি আরও কমে দাঁড়ায় চার শতাংশ।
পরের দুই অর্থবছর ভোগ ব্যয় বৃদ্ধির হারে কিছুটা ত্বরণ সৃষ্টি হয়। এতে ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি চার দশমিক আট শতাংশে উন্নীত হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা আরও কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গত অর্থবছর ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় চার শতাংশ। নির্বাচন-পরবর্তী অর্থবছর তা বেড়ে যায় পাঁচ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমে দাঁড়ায় তিন শতাংশ।
ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি কমলেও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বেড়ে গেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল সাত দশমিক ১০ শতাংশ। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় আট দশমিক ৯০ শতাংশ।
এদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধির অবদান অনেক কমে গেছে। গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় সাত দশমিক ১১ শতাংশ। এর মধ্যে এক দশমিক ৯৭ শতাংশ এসেছে ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি থেকে। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ অবদান ছিল তিন দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর সে বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ছয় দশমিক ছয় শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অর্ধেকের বেশি অবদান ছিল ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধির। গত অর্থবছর এ অবদান কমে ২৮ শতাংশে নেমে আসে।
ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধির বিপরীত চিত্র ছিল বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে ২২ শতাংশের কিছু বেশি। পরের অর্থবছর তা অস্বাভাবিক বেড়ে ৩৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এমন পরিস্থিতিতেও এক বছরের ব্যবধানে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাতে এক শতাংশ বেড়ে ২২ থেকে ২৩ শতাংশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি কিছুটা অসঙ্গতিপূর্ণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত অর্থবছর হঠাৎ বিনিয়োগ বাড়ানোর একটা প্রবণতা দেখা যায়। এ সময় (২০১৫-১৬) প্রত্যাশার চেয়ে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি বিনিয়োগ হয়েছে বলে দেখানো হয়। অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে এপ্রিলে বিবিএস সাময়িক হিসাব করে বলেছিল, ওই বছর চলতি মূল্যে তিন লাখ ৭৬ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকার বেসরকারি বিনিয়োগ হবে। পরে বছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে দেখা গেল, তিন লাখ ৯৮ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে। গত অক্টোবরে এ হিসাব দেয় বিবিএস।
যদিও এর সঙ্গে একমত নন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অবকাঠামো সমস্যার কারণে নতুন শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জমির স্বল্পতা। এজন্য ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমা হচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করছে, তার চেয়ে কম বিনিয়োগ হচ্ছে।
এদিকে গত অর্থবছর সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির অবদান জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কমেছে। বিবিএসের হিসাবে, গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির অবদান কমে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৩৪ শতাংশ। আগের অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এর পরিমাণ ছিল দশমিক ৭৭ শতাংশ।
গত অর্থবছর বিনিয়োগের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান মূলধন-উৎপাদন অনুপাত (আইসিওআর) বাংলাদেশে এখনও সাড়ে চার শতাংশের নিচে নয়। ফলে সাত দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ হওয়া উচিত জিডিপির ৩২ শতাংশের কাছাকাছি। বাস্তবে তা হয়নি। এছাড়া ভোগ ও বিনিয়োগ ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা তো আছেই।
Add Comment