সাইফুল্লাহ আমান: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুল আলোচিত উড়োজাহাজ কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ার। গত ১৩ জানুয়ারি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আলোচিত এ কোম্পানিটিকে ‘জেড’ ক্যাটেগরি থেকে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেটে স্থানান্তর করে।
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বিএসইসি কোম্পানিটির আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নেয়ার তিন মাস হলেও ইউনাইটেড এয়ারকে টেনে তোলার চেষ্টায় এখনও বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে নতুন পর্ষদ দেশের বিমানবন্দরে থাকা কোম্পানিটির ১০টি বিমান ও ভারতের বিমানবন্দরে পড়ে থাকা একটি বিমানের নিলাম ঠেকাতে পেরেছে বলে জানা যায়।
এদিকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিটিকে আবার বাঁচিয়ে তোলার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে যে বিপুল পরিমাণ দেনা রয়েছে, তার জরিমানার অংশ মওকুফের চেষ্টা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন পর্ষদ গঠিত হওয়ার তিন মাসে একাধিক বৈঠক করলেও ঋণের সাগরে ডুবে যাওয়া কোম্পানিটিতে নতুন করে ব্যবসায় আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা এখনও দাঁড় করাতে পারেনি। কোন পদ্ধতিতে কোম্পানিটিকে আবার সচল করা যাবে এবং এর বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ফেরত দিতে পারবে, তাও জানে না পর্ষদ।
কোম্পানিটিকে নতুন করে আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কাজী ওয়াহেদুল আলমের নেতৃত্বাধীন নতুন পর্ষদ। এ পর্ষদ কোম্পানির দায়দেনা, সম্পদ ও অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করবে। এমনকি কোম্পানি অবসায়নেরও পরামর্শও দিতে পারবে।
উল্লেখ্য, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি ইউনাইটেড এয়ারের বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয়। সে সময় ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের প্রধান তাসবিরুল আলম চৌধুরীকে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় কাজী ওয়াহেদুল আলমকে।
ওয়াহেদুল আলম বাংলাদেশ বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এভিয়েশন ব্যবসায় তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকায় তার ওপর আস্থা রেখে এ দায়িত্ব দেয় বিএসইসি। গঠিত নতুন পর্ষদে তার সঙ্গে আছেন এম সাদিকুল ইসলাম, মাসকুদুর রহমান সরকার, এটিএম নজরুল ইসলাম, প্রফেসর ড. বদরুজ্জামান ভূইয়া, মুহাম্মদ ইউনুস ও মুহাম্মদ শাহ নেওয়াজ।
নতুন পর্ষদের কার্যক্রম সম্পর্কে কাজী ওয়াহেদুল আলম শেয়ার বিজকে জানান, কোম্পানির আগের দায়দেনা, সম্পদ ও আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বিএসইসির সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। কীভাবে কোম্পানিটিকে চালু করা যায়, তা নিয়ে বৈঠক চলছে। চাওয়া হয়েছে আর্থিক সহযোগিতা। কিন্তু কোনোটিই এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে ইউনাইটেডকে কার্যকর করতে তাসবিরুল আলম চৌধুরী সহযোগিতা করার প্রস্তাবও দিয়েছেন। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি নতুন পর্ষদ।
কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘আমরা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে সময় চেয়েছি। তাদের কাছে আমাদের মূল দেনা ৫৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ৭৮ শতাংশ সারচার্জ যুক্ত হয়ে এটি এখন প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো দাঁড়িয়েছে। আমরা এটি নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা চাচ্ছি যদি প্রিন্সিপ্যাল অ্যামাউন্টটা দেয়া যায়, আর সারচার্জ মওকুফ করা যায় কি না, সেটা নিয়েও কথা চলছে। আমরা বেবিচককে চিঠিও দিয়েছি।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে ইউনাইটেড এয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোম্পানিটির ১০টি উড়োজাহাজ ছিল। বিমানবন্দর ব্যবহারের পাওনা পরিশোধ না করায় জরিমানা আদায়ে সেগুলো নিলাম করার উদ্যোগ নেয় বেবিচক। এই উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে চারটি এমডি এইটটি থ্রি, দুটি এয়ারবাস থ্রি ওয়ান জিরো, তিনটি এটিআর সেভেনটি টু ও একটি ড্যাশ এইট উড়োজাহাজ। নতুন পর্ষদ এই নিলাম না করে সময় দেয়ার অনুরোধ করেছে। আর বেবিচকও তাদের অনুরোধ রেখেছে।
কাজী ওয়াহেদুল আলম জানান, ভারতের ছত্তিশগড়ের রায়পুর বিমানবন্দরেও একটি এমডি এইটটি থ্রি মডেলের উড়োজাহাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। সেটি সম্প্রতি নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিলাম ঠেকাতে ও উড়োজাহাজটির বকেয়া পার্কিং ফি মেটাতে ছয় মাস সময় চেয়েছে ইউনাইটেড এয়ার।
ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘আমরা গত মাসে ভারতের কাছ থেকে নিলাম-সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। এর আগেও তারা বহুবার চিঠি দিয়েছে, কিন্তু আগের ম্যানেজমেন্ট এ-সংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত মাসে আমাদের যে চিঠি দেয়া হয়েছে, তাতে রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পাওনা পরিশোধ না করলে তারা উড়োজাহাজটি নিলামে তুলবে। আমরা তাদের বলেছি, আমাদের কাছে তো কোনো ডকুমেন্ট নেই। তোমরা আমাদের ডকুমেন্ট দাও। আমরা তাদের কাছে পাওনা শোধে ছয় মাস সময় চেয়েছি। এটি ভারতীয় হাইকমিশন ও বেবিচককেও জানানো হয়েছে।’
এই বিমান ফিরিয়ে আনা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উড়োজাহাজটি ফিরিয়ে আনতে আগে এটির ইন্সপেকশন করতে হবে এটি কী অবস্থায় রয়েছে তা জানতে। এজন্য একটি ইন্টারন্যাশনাল টেকনিক্যাল অডিট করা হবে। তারপরে আমরা বুঝতে পারব এটি নিয়ে আসা ভায়াবল হবে কি না। তারা (রায়পুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ) বলেছে, উড়োজাহাজটির পার্কিং ফি বাবদ তারা দুই কোটি রুপির মতো আমাদের কাছে পাবে।’
নতুন পর্ষদ গঠন এবং তাদের কার্যক্রমের পরও ইউনাইটেড এয়ারের পর্ষদ পুনর্গঠন নিয়ে আশাবাদী নয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ইউনাইটেডের ব্যাপারে আমি আশাবাদী নই। কারণ তারা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের পর্ষদ পুনর্গঠন হয়েছে আমি শুনেছি। কিন্তু কেন করেছে? কী কারণে? আবার চালু করবে কি না, এটার বিষয়ে কোনো তথ্য এখনও নেই। ফ্লাইট চালুর কোনো অ্যাপ্লিকেশনও তারা এখনও করেনি।’
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদও মনে করেন ইউনাইটেড এয়ারকে আবার চালু করা কঠিনই হবে। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি এয়ারওয়েজকে আবার চালু করা খুবই কঠিন। এর দায়দেনা, আয়-ব্যয় সবকিছু নতুন করে বিবেচনা করতে হবে। এখন দেখা যাক, কী হয়। আমাদের পক্ষ থেকে যা করা দরকার আমরা তা করব।’
আলোচিত এ কোম্পানিটির পাঁচ বছর ধরে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত না করা, বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ না দেয়া এবং নিয়মিত এজিএম না করার কারণে সম্প্রতি পুঁজিবাজারের মূল মার্কেট থেকে ইউনাইটেড এয়ারকে সরিয়ে দেয়া হয়। গত ১৪ জানুয়ারি থেকে কোম্পানিটি লেনদেন হচ্ছে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেটে।
ওটিসিতে পাঠানো এক মাসের ব্যবধানে পর্ষদ পুনর্গঠনের খবরে আগ্রহ বাড়ে বিনিয়োগকারীদের। ওটিসি মার্কেটে এমনও কোম্পানি আছে, যেগুলোর শেয়ার বিক্রির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়ে। কিন্ত পর্ষদ পুনর্গঠনের খবরে মাত্র এক মাসে এক কোটির বেশি শেয়ার বিক্রি হয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের। কিন্তু তিন মাসেও কোম্পানিটির কোনো অগ্রগতি না থাকায় আগ্রহ হারায় বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে শেয়ারের ক্রেতা না থাকায় কোটির বেশি শেয়ার পড়ে আাছে বিক্রির অপেক্ষায়।