ফারুক আলম, লালমনিরহাট: বহুরূপী তিস্তা বর্ষাকালে এক রূপ, আর শুষ্ক মৌসুমে ভিন্ন। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার চরাঞ্চল সবুজ সমতলের রূপ নেয়। গ্রীষ্মের পরপর হঠাৎ পানির বৃদ্ধি ও কমায় ব্যাপক ক্ষতিতে পড়েন চরাঞ্চলের কৃষকসহ তিস্তা পাড়ের মানুষ। নদীভাঙন আর হঠাৎ পানি বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে যায় চরাঞ্চলের ফসল। তবু হাল না ছাড়া মানুষ তিস্তায় চাষাবাদ করেন। ছয় মাসের চাষাবাদে তাদের জীবন চলে। বাকি ছয় মাস কর্মসংস্থানের জন্য চলে যায় বিভিন্ন শহরে।
তিস্তাপাড়ের লতিফ মিয়া বলেন, আমরা চরে চাষ করা শিখে গেছি। শুষ্ক বালুতে প্রথমে আলু, পরেরবার বাদাম, তারপর যা চাষ করব, তা-ই ফলবে।
৭০ বছর বয়সী নূর মোহাম্মদ। জীবনে ২৭ বার বাড়ি ভেঙেছে তিস্তায়। গত বছরও। এবারও ভাঙনের মুখে। এবার তিনি অন্যের জমিতে ঘর তুলে বাস করছেন। চলতি বছর কয়েক দফায় ২৭০০ টাকার বাঁশ কিনে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
৬৫ বছর বয়সী বিধবা হালিমা বেগম বলেন, একাই তিস্তার চরে থাকি। গত ৫০ বছরে কমপক্ষে ১৫ বার তিস্তার ভাঙন দেখেছি।
কৃষক ইয়াকুব আলী (৬৫) বলেন, অনেকবার তিস্তার ভাঙন দেখেছি। গাছপালা গরু ছাগল নিয়ে বাড়ি ভাঙার সময় বুক ফেটে যায়। গতবার মন্ত্রী এলো, এমন ভাবে বলল যেন তখনই বাঁধ হয়। চেয়ারম্যানরা মিলে টাকা তুলে। আরও অনেকের কাছে কয়েক লাখ টাকা এনে একটি বালির বাঁধ দেয়া হচ্ছে। ওই বাঁধটাও টিকল না। নদীর ভাঙা-গড়ার সঙ্গে বুকও ভাঙে গড়ে।
লালমনিরহাটে বর্ষা এখনও জেঁকে বসেনি। তারপরও তিস্তার পানি কমা বাড়া করার কারণে ভেঙেছে তিনবার। স্থানীয়দের চাঁদায় করা একটি বিশাল বালির বাঁধ গত ১০ দিনে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তবু ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তিস্তাপড়ের ভাঙনকবলিত মানুষরা বাঁধ ও ভাঙন রোধে সর্বস্তরের কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কিন্তু প্রতিকার পাননি।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, বালির বাঁধটি দেয়ার সময় তাদের সায় ছিল না। স্থানীয়রা এ বাঁধটি তৈরি করেছেন। এমন বাঁধ তিস্তায় টেকে না। ভাঙনকবলিত এলাকার জন্য সব রকম প্রস্তুতি রয়েছে। ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। যে কোনো সময় প্রকল্পটি পাস হবে। প্রকল্পটি পাস হলে কিছু কাজ করা যাবে। এছাড়া তিস্তার যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে ছোট প্রকল্পগুলোর আর দরকার হবে না। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে স্থায়ী সমাধান হবে।
গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও তিস্তা ব্যারাজ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি তিস্তার বিভিন্ন ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। বামতীরের ১১৩ কিলোমিটার নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথাও বলেন। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন, প্রকল্পগুলো শুরু করতে এক থেকে দেড় বছর লাগবে।
ভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। নেয়া হয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা। ইতোমধ্যে তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে তিস্তার সেচ প্রকল্পগুলোর কাজ করা হবে বলে পাউবো নিশ্চিত করেছে।
রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারীর চাষাবাদে ১০ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চাষের সময় পানি মিলেছে মাত্র আড়াইহাজার কিউসেক। এ সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় তিস্তার পানি তেমন উপকারে আসছে না বলে জানান কৃষকরা।
তিস্তা পানির বিপদসীমার রেকর্ড পরিবর্তিত হয়েছে পাঁচ বছরে তিনবার। পাউবো লালমনিরহাট দপ্তর রেকর্ড পরিবর্তনের হিসাব দিতে পারেনি। তবে পাউবো রংপুরের বিভাগীয় উপ-প্রকৌশলী কৃঞ্চ কমল চন্দ্র সরকার জানান, গত পাঁচ বছরে তিনবার রেকর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে।
তিস্তার বাম তীর রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ সরওয়ার হায়াত জানান, তিস্তা নিয়ে যে মহাপরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, তা কতদিনে হবে তা বলা মুশকিল। তিস্তা নদী গতিপথ বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব নিয়ে অনেক আন্দোলন করা হয়েছে। কাজ হয়নি।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এখানে কৃষিজাত পণ্যের শিল্প গড়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন ফিড মিল গড়ে উঠতে পারে। তিস্তার চরে প্রতি বিঘায় ৫০ মণের বেশি ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে। মরিচ, পেঁয়াজসহ মসলা জাতীয় ফসল নির্ভর এসব শিল্প গড়ে উঠলে অনেক সম্ভাবনার দাঁড় খুলে যাবে।
তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার সহায় সম্বল ভিটে মাটি হারিয়েছে। তিস্তার ভাঙনে ২,২০,০০০ হেক্টর জমি বিলিন হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় প্রায় ১,২০,০০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা আর পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজ করার সময় বলা হয়েছিল, ব্যারাজের দুই পাশে সিসি ব্লক ডাম্পিং করে এবং মাঝে মাঝে গ্রোয়িং নির্মাণ করে তিস্তাকে একটি নির্দিষ্ট চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত করা হবে। কিন্তু ব্যারাজের ডিজাইনার আইনুন নিশাতের স্বদিচ্ছার অভাবে তিস্তা নদীর বাম তীরে বাঁধ নির্মাণ করেনি।
বর্ষায় গড়ে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার কিউসেক পানি আসে। এই পানি লালমনিরহাট অংশ দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে নদীর নাব্য হারিয়েছে। নদীর প্রস্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ কিলোমিটার, যা দুই কিলোমিটার থাকার কথা। এর কারণে মূলত বন্যা-ভাঙনের কবলে পড়তে হচ্ছে বারবার।
পাউবোর একজন প্রধান প্রকৌশলীর বরাত দিয়ে তাদের গবেষণায় দাবি করছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের পাঁচ শতাংশ খরচ করলে তিস্তা ব্যারাজ থেকে কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটারে প্রটেক্টিভ বাঁধ দেয়া যেত।
উল্লেখ্য ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে শেষ হয়। সেই সময় ব্যারাজ নির্মাণে ২৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।