সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম ডিটি রোড ধনিয়ালাপাড়ার তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফ্যাশন ক্রিয়েট অ্যাপারেলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধার আওতায় ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটে নিবন্ধিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বিনা মূল্যে (প্রচলিত এফওসি) ভিত্তিতে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে এক কোটি ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দার অভিযোগের ভিত্তিতে সত্যতা পাওয়ায় সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের রাজস্ব ফাঁকির প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, শতভাগ তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বিনা মূল্যে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ১৩টি প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে মেসার্স ফ্যাশন ক্রিয়েট অ্যাপারেলস লিমিটেড অন্যতম। ফলে শুল্ক গোয়েন্দার উপ-পরিচালকদের নিয়ে গঠিত একটি তদন্ত টিম প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আলাদা করে অনুসন্ধান করে। এসময় ১৩ প্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত ৫০টি চালানের তথ্য প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়।
এতে মেসার্স ফ্যাশন ক্রিয়েট অ্যাপারেলস লিমিটেড লিয়ন ব্যাংক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা ও ঢাকা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের প্রিন্সিপাল শাখার দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমদানি নীতির আদেশ বিধান লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নো-কস্ট সুবিধার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটির আমদানিকৃত চারটি চালান স্থগিত করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এসময় প্রতিষ্ঠানটির লিয়ন ব্যাংকের দেয়া প্রত্যয়নপত্রের তথ্য এবং সরেজমিনে পরিদর্শন করে শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদন করে।
ওই প্রতিবেদন দেখা যায়, চট্টগ্রামের মেসার্স ফ্যাশন ক্রিয়েট অ্যাপারেলস ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত লিয়েন ব্যাংকের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া এফওসি সুবিধায় পণ্য আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানটি এই তিন অর্থবছরে ৮৬ হাজার ৩১ মার্কিন ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে পরিশোধ না করে পণ্য আমদানি করে, যার মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দশটি চালানের মাধ্যমে ১০টি চালান, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তিনটি চালান ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুটিসহ মোট ১৫টি চালান লিয়েন ব্যাংকের প্রত্যয়নপত্র ও এলসি ছাড়া নো-কস্ট ভিত্তিতে পণ্য আমদানি করে, যার বিপরীতে এক কোটি ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৯ টাকা রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে। ফলে শুল্ক গোয়েন্দা সরকারি রাজস্ব উদ্ধারের জন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির মামলা দায়ের করে।
তারপর চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটিকে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে কারণ দর্শানোর জন্য নোটিস জারি করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি নোটিসের জবাবে জানায়, তাদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ সঠিক নয়। একই সঙ্গে ওই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপনের জন্য তিন মাস সময়ের আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট ২০ দিন সময় মঞ্জুর করে। ওই সময় শেষে প্রতিষ্ঠানটি লিখিত জবাবে বন্ড কমিশনারেটকে জানায়, নো-কস্ট সুবিধার অপব্যবহার ও প্রত্যয়নপত্র ছাড়া এফওসি সুবিধায় ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ১৫টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৯২ হাজার ৭৪৬ কেজি যে কাঁচামাল আমদানি করার কথা বলা হচ্ছে, তা যথাযথভাবে রপ্তানি করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি তাদের লিখিত জাবাবে আরও বলে, আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আদেশের প্রেক্ষিতে এলসি ছাড়া এফওসি মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে থাকে, যা বিভিন্ন সময় ইএক্সপি’র মাধ্যমে চ্যানেল পরিশোধ ছাড়া এফওসির মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি সম্ভব হয়, যা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে রপ্তানি করেছে।
তারপর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং বন্ডারের জবাবের আলোকে বিষয়টি আইনানুগ নিষ্পত্তির জন্য ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণের দিন ঠিক করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট, যা চিঠির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে মামলার বাদী কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধি উপস্থিত হলেও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান নানা অজুহাতে শুনানিতে উপস্থিত হয়নি। তারপর অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটিকে আরও সাতবার ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগ প্রদান করেছিল চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট। তাতেও উপস্থিত হয়নি ফ্যাশন ক্রিয়েট অ্যাপারেলস লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। তবে প্রতিষ্ঠানটি বারবার চিঠি দিয়ে শুনানির তারিখ পরিবর্তনের আবেদন করেছিল, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করার অপকৌশন অবলম্বন করে।
চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্ড অফিসার জানান, সরাসরি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত তথ্য অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম ব্যতীত লিপিবদ্ধ করার জন্য কোনো ধরনের বন্ড রেজিস্টার সংরক্ষণ করে না এবং অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিনে পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে উৎপাদন রেজিস্টার, তৈরি পণ্য মজুত রেজিস্টার, পিআই, এলসি কপি, ডেলিভারি চালান, ব্যাংকের পিআরসি, বিল অব এন্ট্রির কপি বন্ড কমিশনারেটকে প্রদানের জন্য বলা হলেও দীর্ঘদিন তারা তা দাখিল করেনি। যদিও নো-কস্ট ভিত্তিতে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিগত বছরের পারফরম্যান্সের ওপর সনদ ইস্যুর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্ড কশিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমস আইন লঙ্ঘন করেছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ ও বন্ড লাইসেন্স বাতিলযোগ্য। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে রাজস্ব ফাঁকির এক কোটি ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার ২১৩ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমস আইন লঙ্ঘন করায় দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে, যা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ১৫ দিনের মধ্যে মোট চার কোটি ৩১ লাখ ৯৮ হাজার ২১৩ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।