রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য আগর গাছ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। শাখা-প্রশাখাবিহীন সোজা লম্বা গাছগুলো আকার-আকৃতিতে অনেকটা শাল বা গজারি গাছের মতো। এ গাছে সাদা রঙের ফুল ধরে এবং ফলগুলো ক্যাপসুল আকৃতির হয়। গাছের পাতা দেখতে অনেকটা লিচু গাছের পাতার মতো, অনেকে বকুল গাছের পাতার সঙ্গেও মেলাতে পারেন। সাদা রঙের আগর কাঠ খুব নরম হয়। এ কাঠ আতর উৎপাদনের উপকরণ ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
প্রাকৃতিক সুগন্ধির উৎস আগর আনবে বৈদেশিক মুদ্রাÑএমন স্বপ্ন থেকে ২০১১ সালের অক্টোবরের দিকে সম্পূর্ণ শখের বশে আগর চাষ শুরু করেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার কৃষিবিদ এমএ খালেক। উপজেলার ২নং বড়গ্রাম ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামে আট বিঘা সমতল ভূমিতে এখন শোভা পাচ্ছে আগরের হাজার খানেক বিভিন্ন বয়সের চারা।
উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া আগর চাষের উপযোগী। এখানের আগরের কাঠ খুবই সুগন্ধযুক্ত। এর নির্যাস থেকে মূল্যবান সুগন্ধি ও তেল পাওয়া যায়, যা থেকে আতর, আগরবাতি, বডি স্প্রে, সেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধিপণ্য তৈরি করা হয়। অন্যান্য গাছের তুলনায় আগরের বাগান করা সহজ। খরচও তুলনামূলকভাবে কম এবং লাভ বেশি। এক কেজি আগর আতরের দাম পাঁচ লাখ টাকার বেশি।
আগর চাষ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ এমএ খালেক শেয়ার বিজকে বলেন, আগরের নির্যাস থেকে মূলত তৈরি করা হয় আতর বা সুগন্ধি। কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক দুই উপায়েই আগর থেকে সুগন্ধিজাতীয় আতর বা পারফিউম উৎপাদন করা হয়। আমাদের পরিবেশে গাছগাছালি রোপণের পর স্বাভাবিকভাবে তা বড় হলেও আগরের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্ন নিয়ম। এই গাছ রোপণের পাঁচ বছরের মাথায় পুরো গাছে এক ইঞ্চি পরপর পেরেক মারা হয়। তখন গাছ থেকে এক ধরনের রস বের হয়। পেরেকের চারপাশে সেই রস জমে কালো রং ধারণ করে। সেই কালো রংই হলো আতরের বড় উপাদান।
তিনি আরও বলেন, ছোট ফালি করে কাটার পর আগের সব পেরেক খোলা হয়। তখন গাছের কালো ও সাদা অংশ আলাদা করা হয়। সেই কাঠ কারখানার পানিতে এক থেকে দেড় মাস ভেজানো হয়। তারপর সেগুলো স্টিলের ডেকচির মধ্যে দিয়ে অনবরত জ্বাল দেয়া হয়। তখন পাতন পদ্ধতিতে ফোঁটায় ফোঁটায় আতর নির্দিষ্ট পাত্রে জমা হয়। সেগুলো আবার প্রক্রিয়াজাত করে ভাগ করা হয় বিভিন্ন কোয়ালিটিতে। তারপর বোতলবন্দি করে সেই আতর পাঠানো হয় দেশের বাইরে।
মোগল আমলে বৃহত্তর সিলেটে আগরশিল্পের সুনাম ছিল বিশ্বজুড়ে। বর্তমানে সুনামগঞ্জের ছাতকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সরকারিভাবে আতর উৎপাদিত হচ্ছে।
আগর-আতর উৎপাদন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এ ব্যবসায় অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা করা সম্ভব। এক কেজি কালো কাঠের দাম প্রায় দুই লাখ টাকা। একটি আগর কাঠসমৃদ্ধ প্রাপ্তবয়স্ক গাছের মূল্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ এমনকি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আগর প্লান্টেশনে বিনিয়োগ করে উচ্চ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। অন্য জরিপে জানা যায়, সঞ্চয়পত্রে এক ডলার বিনিয়োগ করলে ১২ বছর পর চার ডলার ২১ সেন্ট পাওয়া যায়, অপরদিকে আগর গাছে এক ডলার বিনিয়োগ করলে ১১৭ থেকে ৭৩৬ ডলার পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া আগর একটি পরিবেশবান্ধব শিল্প।
আগর-আতরশিল্পের বিকাশে এ শিল্পকে ঢেলে সাজাতে সঠিক পরিকল্পনা, পলিসি, উদ্যোগ ও উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন এ শিল্পসংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, আগরশিল্পের মানোন্নয়নে সরকারি উদ্যোগে আগর নিয়ে আধুনিক মানসম্মত গবেষণা করা এবং এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, উদ্যোক্তা, আগর শ্রমিক ও কারিগরদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।
মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আতরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া জাপান, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশেও এটি প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে রপ্তানিমুখী এ শিল্পের বিকাশে জরুরি ভিত্তিতে আগর গাছের ওপর গবেষণা জোরদার, চাষ সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনাসহ প্রক্রিয়াজাতকরণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নেয়া উচিত।