সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে নগরায়ণ ও নাগরিক সুবিধা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে গত দেড় বছরে চট্টগ্রামভিত্তিক ৮৪টি আবাসন কোম্পানির পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে ২৫০টি প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। আর সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। আর প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা থেকে বিরত আছে। পাশাপাশি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট বিক্রি নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
চট্টগ্রামভিত্তিক আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা যায়, ফ্ল্যাট বিক্রি কমে যাওয়ার পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। রডের দাম প্রতি টনে ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ৭৪ হাজার টাকা হয়েছে, সিমেন্ট ৩৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা এবং অন্যান্য উপকরণের দাম ক্ষেত্রেভেদে দ্বিগুণ হয়েছে। পাশাপাশি মধ্যভিত্তি শ্রেণির আয়, পুঁজি ও ডিপোজিট কমেছে। ফলে চট্টগ্রামভিত্তিক ৮৪টি আবাসন প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ আবাসান প্রতিষ্ঠান নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকছে।
বর্তমানের এসব প্রতিষ্ঠানের ২৫০টি প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি স্থবির অবস্থায় আছে। আর এসব প্রকল্পে কোম্পানিগুলোর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। সঠিক ও নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় এসব প্রকল্পে কোম্পানির লোকসান হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এছাড়া করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে না আসায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে চলমান প্রকল্পের কাজও যেকোনো সময়ে বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি নতুন ও পুরোনো বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট বিক্রিও নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। যদিও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আট-নয় শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। একই অবস্থা ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন নির্মাণ কার্যক্রমে।
অপরদিকে নতুন ও পুরোনো ফ্ল্যাট বিক্রির ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান বিপ্রপার্টিসের এক সেল পরিসংখ্যান রিপোর্টে দেখা যায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগরে স্থবির হয়ে পড়ে নতুন ও পুরোনো ফ্ল্যাট বিক্রি। প্রতিষ্ঠানটির মধ্যস্থতায় গত এপ্রিল মাসে চারটি, মে মাসে চারটি, জুন মাসে দুটি এবং জুলাই মাসে মাত্র একটি ফ্ল্যাট হাতবদল হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ, তা আমরা টের পাচ্ছি। আমাদের মাধ্যমে গড়ে ১০টি ফ্ল্যাট বিক্রির কাজ হয়ে থাকে, কিন্তু এখন ৯০ শতাংশ সেল ডাউন।’
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে চলতি বছরের নতুন ভবন নির্মাণে উল্লেখ করার মতো কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়নি।
একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আসলে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার প্রভাব আবাসন খাতে অনেক আগেই পড়েছে। একদিকে নির্মাণসামগ্রীর দাম ৪০-৪৫ শতাংশও বেশি বেড়েছে, অপরদিকে ক্রেতা নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান সরাসরি কিছু বলত না, কারণ ক্রেতার অসন্তোষের মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে। আমাদের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ অনেক সেøা হয়ে পড়েছে। আবার নতুন প্রকল্প তো শুরু করা হয়নি। আর অফার এলেও নতুন প্রকল্প নিতে পারছি না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অনেক সময় লাগবে।’
এ বিষয়ে আবাসন মালিকদের সংগঠন রিহ্যাব চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী বলেন, ‘আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা অনেক চাপে আছেন। এ খাতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। একদিকে করোনারভাইরাসের প্রভাব, অন্যদিকে নির্মাণসামগ্রীর দাম কয়েক দফায় বেড়েছে। আর বর্ষা শেষ হলেও ইস্পাতের দাম আরও বাড়বে বলে শুনছি। আসলে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ছে। তবে সরকারের উচিত ইস্পাত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, অন্যান্য খাতে সরকার প্রণোদনা দিলেও এককভাবে আবাসন খাতে কোনো প্রণোদনা দেয়া হয়নি। আর কিছু কিছু ব্যাংক আবাসন খাতে প্রণোদনা দিলেও ৯৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা পায়নি। এছাড়া আমরা আবাসন খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার একটা ফান্ড চাইলেও সরকার এখন পর্যন্ত অনুমোদন করেনি। আর করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে আবাসন খাত মন্দায় থাকবে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবারও আবাসন ঘুরে দাঁড়াবে।’