নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের জমি কেনায় কমিশন বাণিজ্য

জয়নাল আবেদিন: বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক বেশি দামে জমি কিনেছে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক। নেয়া হয়নি পূর্ণ পর্ষদের মতামত। এতে লাভবান হয়েছেন বাংলাদেশি পরিচালকসহ নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ধুঙ্গানা। ব্যাংকের ক্ষতি ঠেকাতে বিস্তর তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্র ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে পরিচালক দিপক কারকি।

জানা যায়, নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর বিশালনগরে জমি কেনা হয়। নেপালি পরিমাপক একক অনুযায়ী, জমির পরিমাণ সাত রোপানি ৯ আনা (এক রোপানি সমান ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর এক আনা সমান দশমিক ৭৯ শতাংশ। ১৬ আনা সমান এক রোপানি। সে হিসাবে বাংলাদেশি পরিমাপক একক অনুযায়ী মোট জমির পরিমাণ ৯৫ দশমিক এক

শতাংশ)।

বর্তমানে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদে রয়েছেন মোট ছয়জন। এর মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি ও বাকি তিনজন নেপালের নাগরিক। বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন এআরএম নাজমুস সাকিব, শাহ আলম সারওয়ার ও কামরুন্নাহার আহমেদ। নেপালের পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন ইন্দ্র বাহাদুর থাপা, মুকুন্দ নাথ ধুঙ্গেল ও দিপক কারকি। অন্যদিকে ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে আছেন জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ ধুঙ্গনা।

নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে তাদের দেশে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর অপকর্মের কারণে বদনাম কুড়াতে চান না অপর অংশের একাধিক পরিচালক। বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি ক্রয় ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে অল্প দামে শেয়ার বিক্রির অপবাদ নিতে চান না তারা।

পরিচালক দিপক কারকি এ বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে দেশটির ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংক (এনআরবি) ও দুর্নীতি দমন সংস্থা কমিশন অব দ্য ইনভেসটিগেশন অব অ্যাবিউস অব অথরিটি (সিআইএএ) বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে সংস্থা দুটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে নেপালের একাধিক পত্রিকায় এসব দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই সংবাদে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ, এনবিবি পরিচালক ও আইএফআইসি ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার ও এনবিবি প্রধান নির্বাহী জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ ধুঙ্গনার নাম এসেছে।

এছাড়া গত ২৫ জুলাই নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক দিপক কারকি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাজমুস সাকিবের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ব্যাংকের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা বড় ধরনের অনিয়মে জড়িত। কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মরিয়া ওই দুই কর্মকর্তাসহ একটি চক্র। অর্থের বিনিময়ে নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও হাতে নিয়ে ফেলেছে চক্রটি। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে দ্রুত পর্ষদ সভা আহ্বানের অনুরোধ জানিয়েছেন দিপক কারকি।

নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের গভর্নরকে লিখিতভাবে দিপক কারকি জানান, আমিও ভূমিক্রয়-সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ছিলাম। কিন্তু আমার মতামত ব্যতীতই ওই জমি কেনা হয়। জমির পরিমাণ সাত রোপানি ৯ আনা (এক রোপানি সমান ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর এক আনা সমান দশমিক ৭৯ শতাংশ। সে হিসাবে মোট জমির পরিমাণ ৯৫ শতাংশ)। ওই দেশের নিয়ম অনুযায়ী এক রোপানি সমান ১৬ আনা। সুতরাং পরিচালকের সিদ্ধান্ত ছাড়াই মোট ১২১ আনা জমি কেনা হয়েছে। বাজারমূল্য অনুযায়ী এই জমির দাম ৫০ লাখ রুপি প্রতি আনা। কিন্তু জমিগুলো কেনা হয়েছে ৭৮ লাখ রুপি প্রতি আনা দরে। সুতরাং প্রতি আনাতে ২৮ লাখ রুপি বেশি ব্যয় করা হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, ১২১ আনা জমি কিনতে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ৩৩ কোটি নেপালি রুপি, যার পুরো টাকাটা ওই চক্র ভাগাভাগি করে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে জমি ক্রয়-বিষয়ক যে অভিযোগ এসেছে, তা ভিত্তিহীন। জমি কেনার সময় কোনো অনিয়ম হয়নি। তাছাড়া জমিটা কেনার সময় আর নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংককে অবহিত করেছি। কিন্তু এখন কেন ওই জমি কেনা নিয়ে অভিযোগ আসছে তা আমার বোধগম্য নয়।

তিনি আরও বলেন, অভিযোগ আসতেই পারে। তবে অভিযোগ আসা মানেই অনিয়ম প্রমাণ হওয়া নয়। তারা যদি অভিযোগ এসে থাকে তাহলে রাষ্ট্র ব্যাংক তদন্ত করুক। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই।

উল্লেখ্য, নেপাল ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানার ব্যাংক নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিবিএল) প্রধান উদ্যোক্তা বাংলাদেশের প্রথম প্রজšে§র বেসরকারি ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (আইএফআইসি ব্যাংক)। ১৯৯৪ সালে এনবিবিএল তার কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই যুগ পর ব্যাংকটির উদ্যোক্তা আইএফআইসি ব্যাংক বিনিয়োগ প্রত্যহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৩ জুলাই আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এনবিবিএলে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে ওই অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। শেয়ারের প্রত্যাশিত দাম, ক্রেতার সঙ্গে সন্তোষজনক চুক্তি, আর দুই দেশের সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনক্রমে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। ১৯৯৪ সালের ৬ জুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ব্যাংকটির ৮৩টি শাখা রয়েছে। এনবিবিএল ইনভেস্টমেন্ট ও এনবিবিএল সিকিউরিটিজ নামে ব্যাংকটির দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রয়েছে।

নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৫ সালে নেপাল স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এ ব্যাংকের মোট শেয়ারসংখ্যা ৯ কোটি ৪৮ হাজার ২১২টি। ব্যাংকের ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ারের মালিক আইএফআইসি ব্যাংক, সংখ্যায় যা তিন কোটি ৬৮ লাখ ২৭ হাজার ৪২৬টি।

গতকাল নেপাল স্টক এক্সচেঞ্জে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার ৪৯১ রুপি দরে বিক্রি হয়েছে। শেয়ারটির ক্লোজিং মূল্য ছিল ৪৯১ রুপি। শেয়ারটির অভিহিত মূল্য ১০০ রুপি। অভিহিত মূল্য হিসেবে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য ৩৬৮ কোটি ২৭ লাখ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা (১ রুপি সমান ০.৭১ টাকা হিসেবে)। আর আজকের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে ওই শেয়ারের মোট মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৮০৮ কোটি ২২ লাখ টাকা।

তবে আইএফআইসি ব্যাংক তার ধারণকৃত শেয়ারের মূল্য হিসেবে কত পাবে, তা নির্ভর করবে কত দামে ওই শেয়ার বিক্রি হয়। বিধি অনুসারে, আইএফআইসি ব্যাংককে তার শেয়ার বিক্রির জন্য নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য উদ্যোক্তাদের কাছে আগে প্রস্তাব দিতে হবে। তাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে অন্যদের কাছে তা বিক্রি করা যাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০