অর্থের প্রবাহ কমে যাওয়ার শঙ্কা

সংকট সামাল দিতে ডলার বিক্রি অব্যাহত বাংলাদেশ ব্যাংকের

শেখ আবু তালেব: অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছে। ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ। এতে ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে ডলারের চাহিদা। অনেক ব্যাংকের কাছেই প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলার নেই। ডলার চাহিদা মেটাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গতকালও ছয় কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ নিয়ে গত এক মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছেড়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সূত্র অনুযায়ী জানা গেছে এমন তথ্য।

বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নিলামও আপতত স্থগিত রেখেছে। সর্বশেষ ১৭ আগস্ট নিলাম ডেকেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের। এরপর কোনো নিলাম অনুষ্ঠিত হয়নি। এদিকে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিতে বেড়েছে এর বিনিময় হার। বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত ডলার ছেড়ে দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। গতকালও ছয় কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ২০ পয়সা। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৫১১ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ বিলিয়ন। অপরদিকে প্রবাসীদের পাঠনো রেমিট্যান্সের প্রবাহ কিছুটা কমতে শুরু করেছে। গত আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮১ কোটি ডলার। গত বছরের আলোচিত মাসে দেশে প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। এ হিসাবে একক মাস অনুযায়ী গত আগস্টে সাত দশমিক ৮৪ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে দেশে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বিদায়ী অর্থবছরে পর্যাপ্ত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ। এক বছরে দেশে রেমিট্যান্স আসে প্রায় দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। কিন্তু আমদানি চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজারে উদ্বৃত্ত ডলার ছিল। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ৭৯২ কোটি ২০ লাখ ডলার কিনে নেয়। যার স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৪.৮০ টাকা) প্রায় সাড়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকা।

গত অর্থবছরে যে হারে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে, চলতি অর্থবছরের শুরুতেই তা হোঁচট খায়। গত জুলাইতে রেমিট্যান্স আসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। গত জুলাইতে রেমিট্যান্স আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। অর্থবছরের শুরুতেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। কিন্তু কভিডের দ্বিতীয় ধাক্কা কাটতে শুরু করছে সবেমাত্র। এতে বেড়ে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। তবে এর পরবর্তী তথ্য এখনও হালনাগাদ হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের। একদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে, অপরদিকে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। এতে ব্যাংকগুলোর ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছে না কিছু ব্যাংক। বাধ্য হয়েই তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পাততে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহের হার কমে গেলে ডলারের মান আরও বেড়ে যাবে। ফলে পূর্বের বছরের চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা খরচ হবে ডলার কেনা বাবদ। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের। ব্যাংকাররা বলছেন, বর্তমানে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের কাছে আমানতের ঘাটতি নেই। কিন্তু কয়েক ব্যাংকের অবস্থা ভালো হলেও অধিকাংশেরই চাহিদা মিটছে শুধু। কিন্তু এভাবে ডলারের চাহিদা বাড়লে আমানত সংকটে পড়বে খুব শিগগির।

কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা বলছেন, ডলার কিনতে টাকা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। একপর্যায়ে দেখা যাবে, দৈনন্দিন চাহিদাই মেটানো যাচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে, সুদহার চার শতাংশের নিচে হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে পূর্বের মতো আমানত আসছে না। অর্থ চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ আগস্ট আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দিয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির নিচে নামানো যাবে না ব্যক্তিপর্যায়ের আমানতের সুদহার। যদিও নতুন সুদহার এখনও বাস্তবায়ন করেনি অধিকাংশ ব্যাংক। নতুন সুদহার বাস্তবায়ন হলে আমানত প্রবাহ ব্যাংকগুলোতে বাড়তে পারে। এটি না বাড়লে সংকটে পড়তে হবে ব্যাংকগুলোতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা অর্থাৎ টাকার বিনিময় হারে তেমন একটা হেরফের হয়নি। অর্থাৎ প্রতি ডলার ৮০ টাকা ৮০ পয়সা দরে বিক্রি হয়। ২০২০ সালের শেষের দিকে কিছুটা বৃদ্ধি পেতে থাকে। গত জানুয়ারি মাসে ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার দাঁড়ায় ৮৪ টাকায়। এটি গত জুন পর্যন্ত এই হারেই ছিল। কিন্তু গত জুলাইয়ের শেষ দিকে ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হতে শুরু করে। আগস্টে এসে ৮৫ টাকা ১০ পয়সায় দাঁড়ায় বিনিময় হার। গতকাল তা ৮৫ টাকা ২০ পয়সায় উঠে। এভাবে ডলারে দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রি ও ক্রয়ের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক গত জানুয়ারি মাসে তিন কোটি ডলার বিক্রি করেছিল। এর ছয় মাস পর সর্বশেষ গত ২৪ জুন বিক্রি করেছিল ৫০ লাখ ডলার। জুনের পর গত ১৯ আগস্ট এক সঙ্গে সাত ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা হয় পাঁচ কোটি ডলার।

অপরদিকে খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকার ওপরে চলে গিয়েছে। এতে ডলারের বাজার ক্রমেই অস্তিতিশীল হয়ে উঠছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০