সৈয়দ মহিউদ্দীন হাশেমী, সাতক্ষীরা: সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সাতক্ষীরায় বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবাসহ কয়েক হাজার ভাতাভোগী প্রাপ্য পাওনা থেকে নানাভাবে প্রতারিত হয়েছেন।
মোবাইল ফোনে অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ভাতাভোগীদের প্রাপ্য টাকা নিজ অ্যাকাউন্টে প্রথমবারের মতো ছয় মাসের এককালীন তিন হাজার ও পরবর্তী তিন মাসের জন্য ১৫০০ টাকা দেয়া হলেও কয়েক হাজার ভাতাভোগী আজও সেই পাওনা থেকে বঞ্চিত।
অসচ্ছল এ ভাতাভোগীরা দিনের পর দিন উপজেলা, জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেও তদের প্রাপ্য ভাতার টাকা না পেয়ে ফিরে এসেছেন। এ কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এ ধরনের সেবা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ উঠেছে।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় মোট চার হাজার ৭০০ ভাতাভোগী তাদের প্রাপ্য সরকারি টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তবে শ্যামনগর উপজেলা বাদে সাতক্ষীরার বাকি ছয়টি উপজেলায় ভাতা বঞ্চিতদের সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বারদের।
তিন মাস অতিবাহিত হলেও ভুক্তভোগী অসচ্ছল এ ভাতাভোগীদেরে প্রাপ্য টাকা আজও বুঝে দিতে পারেনি স্ব স্ব উপজেলা সমাজসেবা অফিস ও কর্মকর্তারা। ফলে সহায়তার অর্থ না পেয়ে অনেক দরিদ্র মানুষ হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য মতে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবাসহ চার হাজার ৭০০ বিভিন্ন ভাতাভোগী তাদের ভাতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫১৯, তালা উপজেলায় ৪০২, কলারোয়া উপজেলায় ৮০৫, দেবহাটা উপজেলায় ৫১৩, কালীগঞ্জ উপজেলায় ১৭২৫, আশাশুনি উপজেলায় ৮৯৬ ও সাতক্ষীরা পৌরসভায় ১৪০ জন ভাতাভোগী বিভিন্ন ত্রুটির কারণে তারা টাকা পাননি। তবে বাস্তবে সরকারি বরাদ্দের এই টাকা বঞ্চিতদের সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি।
ভাতাভোগীদের অভিযোগ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সেবা পেতে হয়রানি ও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
সরজমিন সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, এগারানি গ্রামের বাসিন্দা নুরজাহান বিবি (৬৫) গত দুই বছর ধরে নিয়ম অনুসারে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে বয়স্ক ভাতা পেয়ে আসছেন। কিন্তু গত অর্থবছরের অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ছয় মাসের এককালীন তিন হাজার টাকা ও পরবর্তী এপ্রিল, মে ও জুনের দেড় হাজার টাকা মোবাইল ব্যাংকিং নগদ একাউন্টের মাধ্যমে দেয়ার কথা ছিল। এজন্য সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কথামতো, নিজের মোবাইল ফোন থেকে অ্যাকাউন্টও করেছিলেন তিনি। কিন্তু দুই দফায় তিনি কোনো টাকা পাননি। এজন্য সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে মোট ১১ বার খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন। প্রতিবার ১০০ টাকা হারে যাতায়াতের দরুন তার এক হাজার ১০০ টাকা খরচ হয়েছে। উপরন্তু অফিস কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পেয়েছেন অসহযোগিতা ও দুর্ব্যবহার।
শুধু নুরজাহান বিবি নন, তার মতো এ ইউনিয়নের বয়স্ক ও বিধবা ভাতা পাননি রিজিয়া বেগম, বানু বিবি, রাহেলা বেগম, ফুলমতিসহ আরও অনেকে। মাসের পর মাস সমাজসেবা অফিসে গিয়েও কোনো সমাধান মেলেনি।
তালার পাটকেলঘাটা থানার যুগীপুকুরিয়া গ্রামের মৃত ডা. আবুল হোসেন বিশ্বাসের স্ত্রী লুৎফুননেচ্ছা বেগম জানান, গত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে মোট ছয় মাসের বয়স্ক ভাতা বাবদ তিন হাজার টাকা তিনি পাননি। কিন্তু পরবর্তী চলতি বছর এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাসের ১৫০০ টাকা তিনি মোবাইল ব্যাংকিং নগদ একাউন্টের মাধ্যমে পেয়েছেন।
তিনি বলেন, আমার পিন নম্বর বা মোবাইল ফোন নম্বর ঠিক আছে। তাহলে গত ছয় মাসের ভাতার তিন হাজার টাকা আমি পেলাম না কেন? এর যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দেয়া বেশিরভাগ ভাতাভোগী তিন হাজার করে সরকারি এ টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চিতদের অভিযোগ, স্থানীয় সমাজ সেবা অফিসের কিছু অসাধু
কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে একটি প্রতারকচক্র এ টাকা উত্তোলন করেছে। অনেকে টাকা পেয়েছেন আবার অনেকে দুই দফায় দেয়া ছয় মাসের তিন হাজার ও পরবর্তী তিন মাসের এক হাজার ৫০০ টাকা পাননি।
সাতক্ষীরা জেলা সমাজসেবা অফিসের উপপরিচালক সন্তোষ কুমার নাথ শেয়ার বিজকে জানান, সাতক্ষীরায় ৯৯ হাজার ২৮২ জন বয়স্ক ভাতা, ৪৮ হাজার ২৯৪ জন বিধাব ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা ৩১ হাজার ৭৬৮ জনসহ জেলায় মোট এক লাখ ৮১ হাজার ৪৯৪ জন রয়েছেন। কিন্তু এবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা দেয়ায় সমস্যায় পড়েছেন ভাতাভোগীরা।
তিনি বলেন,অনেক সময় ভুক্তভোগীর পিন নাম্বার জেনে ফেলার কারণে প্রতারকচক্র টাকা তুলে নিতে পারে। তবে মোবাইল বন্ধ, পিন নাম্বার ভুল ও সিম ইনভ্যালিড হওয়ার কারণে জেলায় চার হাজার ৭০০ ভাতাভোগী সমস্যায় পড়েছেন। সমস্যা সমাধানের জন্য অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছে। আশাকরি শিগগির সমাধান হবে।
