মো. আসাদুজ্জামান নূর: সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস খাত। কভিড-১৯-এর কারণে অন্যান্য খাতের ব্যবসা মন্দ হলেও ইতিবাচক রয়েছে এ খাত। দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিশ্বের ১৫১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে উৎপাদিত ওষুধ। গবেষণা বলছে, আগামী এক দশকের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফার্মা শিল্পের আকার তিনগুণ বড় হবে। বাজার দাঁড়াবে এক লাখ কোটি টাকায়। পাশাপাশি বার্ষিক রপ্তানি আয় হবে এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস খাত।
এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে ভালো করছে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো। বেশিরভাগ কোম্পানিই নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় বিনিয়োগকারীদের। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ফার্মাসিউটিক্যালস ও কেমিক্যালস খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে ৩১টি। তবে বাংলাদেশে অ্যাসোসিয়েশনস অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইনস্টিটিউশনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১৭৩টি কোম্পানি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপেক্ষাকৃত ভালো কোম্পানিগুলোই পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এদিকে ফার্মাসিটিউক্যালস খাতের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির ব্যাপারে জেনে আশাবাদী হয়ে উঠছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরে এসিআই, বীকন, বেক্সিমকোসহ বেশিরভাগ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে। গত এক বছরের গ্রাফে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরের ঊচ্চমুখী প্রবণতা দেখা যায়।
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারী মশিউর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো বরাবরই ভালো করে। তারাও নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদান করে। ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ করলে এখানে খুব বেশি লোকসানে পড়তে হয় না। তার ওপর আগামীতে ওষুধ খাতে যে উন্নয়নের কথা শুনছি, তাতে এই খাতে বিনিয়োগ লাভজনক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
কভিডকালেও ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ধস নামেনি বলে উল্লেখ করে ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসের কোম্পানি সচিব মো. মহিউদ্দীন বলেন, কভিডের মধ্যে অনেক কোম্পানির ব্যবসা ভালো হয়েছে, আবার অনেক কোম্পানি খুব ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। আমরাও মোটামুটি ব্যবসা করেছি। কভিডকালে যেসব ওষুধের বিক্রি বেশি ছিল, সেসব কোম্পানি কয়েকগুণ মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে। অনেকেই মোটামুটি ব্যবসা করেছে।
এদিকে রপ্তানি আয়েও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার পাশাপাশি উন্নত বাজারেও গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করছে তারা। কোম্পানিগুলো বিদেশে সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্ক স্থাপন করছে। এরই মধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ সব উন্নত দেশের বাজারে প্রবেশ করেছে। তাদের কঠোর নিয়মনীতির মধ্যেও কোম্পানিগুলো সেখানে রপ্তানির জন্য আরও অনেক ওষুধ নিবন্ধন করতে তৎপর রয়েছে। স্কয়ার, বেক্সিমকো ও রেনাটার মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু ওষুধ কোম্পানি উন্নত দেশে তাদের বাজার তৈরি করেছে। এছাড়া ডিবিএল ফার্মা, এসিআইসহ নতুন রপ্তানিমুখী কোম্পানিগুলোও এর জন্য বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের সচিব এম শফিউজ্জামান জানান, বাংলাদেশের ওষুধশিল্প খাতে ইতিবাচক উন্নতি হয়েছে। দ্রুত প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো বিশ্বের ১৫১টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। কিছু কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাজারে এরই মধ্যে বড় ধরনের জায়গা করে নিয়েছে। এর বাইরে আরও এক হাজার পণ্য রপ্তানির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে নিবন্ধিত হতে চলেছে, যা বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উšে§াচন করবে।
বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস খাতের আশাবাদী চিত্র। ‘ইউসিবি অ্যাসেট ফার্মা আউটলুক ইন দ্য ফ্রেশ ডিকেড’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই শিল্পটি আগামী এক দশকের মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার মাইলফলকে পৌঁছাবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ফার্মাসিউটিক্যালস খাত থেকে প্রায় ১৬৯ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি দাঁড়াবে বছরে এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে অর্জিত আয়ের প্রায় ৯ গুণ বেশি। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ১৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে কভিড। গত পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২ দশমিক এক শতাংশ। আগামী ২০৩০ সাল থেকে এই খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে ওষুধশিল্প থেকে রাজস্ব আয়ের ৮৭ শতাংশ আসবে দেশীয় বাজার থেকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নগরায়ণ ও দূষণের কারণে মানুষ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এর ফলে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয়ও বাড়ছে। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কারণে পণ্যের বিক্রিপ্রবাহ বাড়ে। সে হিসেবে বাড়ছে ওষুধ বিক্রিও।
প্রতিবেদনের লেখক মাসুম আলভী চৌধুরী জানান, দেশের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। মানুষের জীবনের প্রথম ৪০ বছরের খাদ্যাভ্যাস তাদের মোটা করছে। ফলে তাদের ৪০ বছরের পরবর্তী জীবনের সব চাহিদা পূরণের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্প। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে হবে মোট জনসংখ্যার ২২ দশমিক চার শতাংশ। বর্তমানে সেটা প্রায় ১৭ শতাংশ।
লাইফস্টাইল, খাদ্যাভ্যাস, ভেজাল, দূষণ প্রভৃতি কারণে দেশে গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, সøায়বিক সমস্যা, ক্যানসার ও হƒদরোগের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে। যেহেতু এই বিপুল জনসংখ্যা ওষুধের ওপর বেশি নির্ভরশীল এবং আধুনিক ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ আগের চেয়ে আরও বেশি আগ্রহী, ফলে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাড়বে বলেও জানান তিনি।
মাসুম আলভী চৌধুরী বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল এভারেজ গ্রোথ রেট ২৪ শতাংশ হারে ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্পে বার্ষিক রপ্তানি আয় এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।