কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। পরবর্তী ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধন অব্যাহত থাকে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন পাকিস্তানি বাহিনী একসঙ্গে হত্যা করে ৩৬৫ নিরীহ মানুষকে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ির অংশ হওয়ায় এলাকাটি পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিশেষ টার্গেট ছিল। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর বুধবার সকালে সেনাবাহিনীর একটি দল ট্রেনে করে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের (তৎকালীন মহকুমা) নিকটবর্তী কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল বড়ইতলাসহ আশপাশের গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের পক্ষে সংগঠিত করা। কিন্তু বড়ইতলা গ্রামে প্রবেশের পর পথ হারিয়ে ফেলায় সেনাবাহিনীর এক সদস্য দলছুট হয়ে পড়ে। পরে একজন সদস্যের স্বল্পতার বিষয়টি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে গুজব ছড়িয়ে দেয় গ্রামবাসী পাকিস্তানি সেনাকে গুম করে ফেলেছে। এ সংবাদের সত্যতা যাচাই না করেই পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা কিশোরগঞ্জের বড়ইতলা, চিকনির চর, দামপাড়া, কালিকাবাড়ী, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর ও ভূবিরচর গ্রামের পাঁচ শতাধিক মানুষকে জোর করে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের পাশে বড়ইতলা গ্রামের একটি স্থানে জড়ো করে। একপর্যায়ে জড়ো হওয়া গ্রামবাসীকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে পাক সেনারা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। বর্বর এ হত্যাযজ্ঞে সেদিন ৩৬৫ জন নিহত এবং আরও দেড় শতাধিক ব্যক্তি মারাত্মকভাবে আহত হন।
এই হত্যাযজ্ঞে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব চিকনিরচর গ্রাম। এখানকার বহু মানুষকে হত্যাসহ জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো গ্রামটিকে। পুরো বরইতলা ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক গণকবর। প্রতিটি পরিবারই হারিয়েছে কোনো না কোনো স্বজনকে। বেয়োনেটের আঘাতে আহত চিকনিরচর গ্রামের মোমতাজ উদ্দিন বলেন, পাকসেনারা আমাকে ও আমার ভাইকে রাস্তা থেকে ধরে বড়ইতলা নিয়ে যায়। সেখানে হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে একজন পাকসেনা আমাকে বেয়োনেট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে আমি অচেতন হয়ে মাটিতে লাশের স্তূপের ওপর পড়ে যাই। পাকসেনারা আমি মারা গেছি মনে করে ফেলে রেখে যায়। পুরো এক দিন আমি লাশের স্তূপের মধ্যে পড়েছিলাম। পরদিন এক মহিলা আমাকে লাশের স্তূপ থেকে উদ্ধার করেন।
একইভাবে গণহত্যায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া দামপাড়া গ্রামের অপর বাসিন্দা আলী আকবর বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর এখানে কয়েক হাজার লোক জড়ো করে পাক সেনারা। এর মধ্যে আমি ও আমার বাড়ির কয়েকজন মানুষকেও এখানে ধরে আনে। এরপর পাকবাহিনী গুলি করে ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ হত্যা করে। আমার আপন চাচা, চাচাতো ভাই, ভাতিজাসহ চারজন মারা যান। আমি অলৌকিকভাবে লাশের স্তূপের নিচে পড়ে গিয়ে রক্ষা পাই। পাকবাহিনী যাওয়ার পর বের হয়ে আসি। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত লাশের নিচে ছিলাম।’
গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া চিকনিরচর গ্রামের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পাকবাহিনী এসে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। অনেক লোকজন একসঙ্গে জড়ো করে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা শুরু করে। আমি লাশের স্তূপের নিচে পড়ে রক্ষা পাই। পাকবাহিনী যাওয়ার পর লোকজন আমাকে বের করে আনে।’
২০০০ সালে বরইতলায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ওই স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মূল সৌধের পাশে দুটি সুউচ্চ পিলারে বড়ইতলা গণহত্যায় ১৫০ শহীদদের নামসংবলিত ফলক লাগানো হলেও আজ পর্যন্ত সব শহীদের নাম সংগ্রহ করে সেখানে ওঠানো হয়নি।
১৯৭১ সালে এদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি, তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
তথ্যসুত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
গণমাধ্যমকর্মী
salma15august@gmail.com