পারভীন লুনা, বগুড়া: বগুড়ার বাল্যবিয়ের কারণে বেশিরভাগ মাধ্যমিক স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমেছে। কভিড-১৯ প্রতিরোধে লকডাউনের পর স্কুল খুলে দেয়া হলে এ চিত্র দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্কুল বন্ধ থাকার সময় বাল্যবিয়ের প্রভাবে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তবে বগুড়ায় সরকারি কোনো দপ্তরে বাল্যবিয়ের পরিসংখ্যান নেই বলে দাবি করা হয়েছে।
বগুড়া জেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় সরকারি নথিতে মোট ৮৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে ৪৪৯টি। ৩১৩টি মাদরাসা, ২৮টি স্কুল ও কলেজ এবং এর বাইরে রয়েছে আরও ৮২টি ডিগ্রি কলেজ। তবে এখন কতজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন, এমন কোনো তথ্য নেই বলে দাবি করেছেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হযরত আলী।
দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত বছর মার্চ থেকে টানা দেড় বছর বন্ধ ছিল। এরপর খুলে দেয়া হয় চলতি বছর ১২ সেপ্টেম্বর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষকদের নজরে আসে অনেক ছাত্রী স্কুলে নিয়মিত আসছে না, অনেকে অ্যাসাইনমেন্টও জমা দিচ্ছে না। পরে শিক্ষকরা জানতে পারেন, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। বগুড়ায় এ চিত্র সারিয়াকান্দি ও শিবগঞ্জ উপজেলায় বেশি বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় বলছে, এ উপজেলায় ৫০টি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। মাদরাসা রয়েছে ৪৪টি। ১৪টি কলেজ রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কতজন শিক্ষার্থী রয়েছে তার তথ্য নেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান খানের কাছে।
শিবগঞ্জের গুজিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪৫০ শিক্ষার্থীর মধ্যে কভিডকালে ৩১ জন ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক তোতা মিয়া। এর মধ্য ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির ২০ ও ১১ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী রয়েছেন। আরও কয়েক জন মেয়ে শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে উপস্থিত নেই। তবে আর কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাও নেই প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে।
শিবগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমানে স্কুলে ছাত্রী অনুপস্থিতির হার ১৫ শতাংশের বেশি। শিক্ষকদের জানা মতে, এ প্রতিষ্ঠানের মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কভিডকালে বাল্যবিয়ে হয়েছে সাতজনের।
প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম বলেন, অনুপস্থিতির হার বাল্যবিয়ের কারণে কমতে পারে। তবে অন্য কারণও আছে হয়তো।
শিবগঞ্জের দাড়িদহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৬৫৮ জন। তাদের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দুটি ব্যাচ রয়েছে। একটি এসএসসি ২০২১, অন্যটি এসএসসি ২০২২। কভিডের আগে এই দুই ব্যাচের শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৭০ শতাংশ থাকলে এখন তা নেমে গড়ে ৩০ শতাংশে এসেছে।
এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বিমল কুমার রায় বলেন, কভিডের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এ সময় শিক্ষার্থীদের অভিভাবক তাদের বিয়ে দিয়েছে।
একই উপজেলার মহাস্থান শাহ্ সুলতান বলখি (র) সিনিয়র আলিম মাদরাসা অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, কভিডের কারণে তার প্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত। অনেক শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ের খবর তিনি পরে জেনেছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির হার কম থাকলেও বাল্যবিয়ের পরিসংখ্যান নিয়ে এক দপ্তর আরেক দপ্তরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেউ বলছেন বাল্যবিয়ের তথ্য মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে, কেউ বলছেন উপজেলা প্রশাসন। তবে কার কাছে এ তথ্য থাকে সেই তথ্য ওই দপ্তরগুলোও বলতে পারে না।
শিবগঞ্জের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মোছা. নাহিদা সুলতানা বলেন, বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এটা আমরা সংরক্ষণও করি না। তবে গত কভিডের মধ্যে দুটি বাল্যবিয়ের খবর পেয়েছিলাম। পরে তা আটকানো হয়েছে।
আর শিবগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, তারা গত এক বছরে ৮৭টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম সম্পা জানান, কভিডকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও দারিদ্র্যের কারণে বাল্যবিয়ের প্রকোপ বেড়েছিল। খবর পেয়ে আমরা অনেক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। কিন্তু উপজেলায় কতগুলো বাল্যবিয়ে হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই আমাদের কাছে। এগুলো মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে থাকতে পারে।
সারিয়াকান্দিতে গত এক বছরে ৯৬২ জন মেয়ে শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন বলছে। যদি শিক্ষা অধিদপ্তরে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। কিন্তু সারিয়াকান্দি উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এবার অনেক বাল্যবিয়ে হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অষ্টম শ্রেণিতে এবার নিবন্ধনে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত।
সম্প্রতি নিজের বাল্যবিয়ের খবর প্রশাসনকে জানায় সারিয়াকান্দি সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসার দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। খবর পেয়ে শিক্ষার্থীর বাড়ি সারিয়াকান্দি পৌর এলাকার হিন্দুকান্দি গ্রামে উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে বন্ধ করে।
শাজাহানপুর উপজেলার আসাতন নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৮৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে কভিডের আগে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি ৯২ শতাংশ থাকলেও এখন সেই হার ৭৫ শতাংশে নেমেছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম উপস্থিতিতে একক কারণ না উল্লেখ করলেও বাল্যবিয়েকে অন্যতম বলে মনে করছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রেজাউল হাসান।
বগুড়া জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, জেলায় কয়টি বাল্যবিয়ে হয়েছে সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করতেও আমাদের বলেনি কখনও।
তবে এবার জেলা শিক্ষা কার্যালয় শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির তালিকা তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে। এটি শেষ হতে আরও এক সপ্তাহ লাগবে বলে জানান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হযরত আলী। তিনি বলেন, ‘সব উপজেলা থেকে এ-সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। সব তথ্য হাতে পেলে আমি আপনাকে দিতে পারব।’
জানতে চাইলে ডিসি মো. জিয়াউল হক বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে উপজেলা প্রশাসন খবর পাওয়া মাত্রই কাজ করছে। এছাড়া মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে আরও কাজ করা হবে।