ইসমাইল আলী: ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৪৬টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। আর ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মাত্র ১৮টি, যার ১২টি সরকারি ও ছয়টি বেসরকারি। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৯০ মেগাওয়াট। তবে ডিজেলচালিত এ কেন্দ্রগুলোয় গত অর্থবছর উৎপাদন ব্যয় পড়েছে ৫৩ টাকার বেশি।
যদিও গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় গড় উৎপাদন ব্যয় তিন টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ গ্যাসচালিত কেন্দ্রের চেয়ে সাড়ে ১৬ গুণ বেশি ব্যয় পড়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। এরপরও এসব কেন্দ্র বন্ধ করা হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ খাতের বোঝা হয়ে উঠেছে এসব কেন্দ্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বেশকিছু ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়। তবে সেগুলোর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে চার বছর আগে বেসরকারি খাতে বড় ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র তথা আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। চাহিদা না থাকায় এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় নামমাত্র। ফলে কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন ব্যয় পড়ছে অস্বাভাবিক। এর সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ছোট ছোট ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ব্যয়ও অনেক বেশি। আর এগুলোর উচ্চ ব্যয়ের প্রভাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়েই চলেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ (আমদানিসহ) ছিল সাত হাজার ৮৫২ কোটি ৫৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছে মোট ৪৯ হাজার ২৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ছয় টাকা ২৭ পয়সা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় হয় হাইড্রো তথা জলবিদ্যুতে। আর সবচেয়ে বেশি ব্যয় ছিল ডিজেলে।
উৎপাদন ব্যয়ের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর হাইড্রো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৬৫ কোটি ৫০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয় ১৮২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ফলে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে মাত্র দুই টাকা ৭৯ পয়সা।
এরপরই রয়েছে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। এ জ্বালানিতেই সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় দেশে। জুন শেষে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১১ হাজার ৪৫০ মেগাওয়াট। গত অর্থবছর এ কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৬৫৫ কোটি ৩১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা মোট উৎপাদনের ৫৯ শতাংশের বেশি। এতে মোট ব্যয় হয় ১৪ হাজার ৯৪৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ফলে গড় উৎপাদন ব্যয় পড়ে তিন টাকা ২১ পয়সা।
এদিকে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে গড়ে ব্যয় হয় পাঁচ টাকা ৮০ পয়সা। বর্তমানে দেশে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। আর গত অর্থবছর দেশটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ ছিল ৮১২ কোটি ৮৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা।
পরের অবস্থানে থাকা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৭৬৮ মেগাওয়াট। আর গত অর্থবছর এ কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৪৯৯ কোটি ৬৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছে চার হাজার ৪১৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে আট টাকা ৮৪ পয়সা। যদিও অন্যান্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১০ টাকার বেশি।
তথ্যমতে, গত অর্থবছর দেশে নবায়নযোগ্য তথা বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ছিল ১২৯ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ১৪ কোটি পাঁচ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয়েছে ১৭৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। ফলে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১২ টাকা ৩৩ পয়সা। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ছয় হাজার চার মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রে উৎপাদন করা হয় এক হাজার ৭৪৪ কোটি ৪১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৫৭২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১২ টাকা ৩৭ পয়সা।
এদিকে গত অর্থবছর ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ছিল এক হাজার ২৯০ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৬০ কোটি ৭২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয় তিন হাজার ২২৯ কোটি সাত লাখ টাকা। আর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ৫৩ টাকা ১৮ পয়সা।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, পিডিবির আওতাধীন ১১টি ডিজেলচালিত কেন্দ্রে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে ২৪৯ টাকা ১৮ পয়সা। রাষ্ট্রায়ত্ত অপর কেন্দ্র নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কেন্দ্রটির গড় ব্যয় ছিল ২৭ টাকা ৮৪ পয়সা। আর বেসরকারি খাতে স্থাপিত ছয়টি ডিজেলচালিত আইপিপির গড় ব্যয় ছিল ৭১ টাকা ১৪ পয়সা।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে স্বল্প পরিসরের চাহিদা মেটাতে পিডিবিকে কিছু ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করতে হয়। উৎপাদন খুবই কম হওয়ায় এসব কেন্দ্রের গড় ব্যয় অনেক বেশি পড়ে। তবে কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর আকস্মিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় চার বছর আগে ডিজেলচালিত বড় আইপিপিগুলো স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে এগুলোর চুক্তির মেয়াদ আছে আর দুই বছর। এরপর কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হলে ব্যয় হ্রাস পাবে।
তিনি আরও বলেন, গত অর্থবছর গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় ডিজেলচালিত বেসরকারি আইপিপিগুলোয় বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। এজন্য এসব কেন্দ্রের গড় ব্যয় কমে এসেছে। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছর এসব কেন্দ্রের ব্যয় অনেক বেশি ছিল। আর চলতি অর্থবছরও গ্যাস না পাওয়ায় এসব কেন্দ্রে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছরও কেন্দ্রগুলোর গড় ব্যয় কমে আসবে।